ফারুক হোসেন সজীব

  ২৭ এপ্রিল, ২০১৯

ভুলু কুকুরছানা

আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, মানে ক্লাস টুতে পড়তাম। সেই সময়ের কথা। আমার একটি সুন্দর নাদুসনুদুস কুকুরছানা ছিল। কুকুরছানাটিকে কোথায় পেয়েছিলাম আগে না হয় সেটাই বলি!

এক দিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম হঠাৎ রাস্তার পাশে সরিষা খেতের ভেতর থেকে ক্যাউ-ক্যাউ আওয়াজ ভেসে আসছিল! এদিক-ওদিকে তাকাচ্ছিলাম কিন্তু আওয়াজের উৎস টের পাচ্ছিলাম না! তবু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আওয়াজের উৎস খোঁজার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ মনে হলো, সরিষা খেতের ভেতর থেকেই বুঝি আওয়াজটা ভেসে আসছে। এগিয়ে গেলাম খেতে ভেতরে। গিয়ে দেখলাম, একটি ছোট্ট কুকুরছানাই অমন করে ডাকছে! ডাকছে? নাকি কান্না করছে, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না! কুকুরের ভাষা কি আর মানুষ বুঝতে পারে?

তবে আমার কাছে মনে হচ্ছিল কুকুরছানাটি যেন কান্না করছিল! কারণ অতটুকু কুকুরছানা তার তো মায়ের কাছে থাকার কথা! সে কেন এই সরিষা খেতের ভেতরে বসে আছে? বুঝতে পারলাম, নিশ্চয় কোনো দুষ্টু লোক তাকে এই খেতের ভেতরে ফেলে রেখে চলে গেছে। কিন্তু এতটুকু কুকুরছানাকে কেউ ফেলে দিতে পারে? আমার ভীষণ মায়া হলো কুকুছানাটির জন্য! শেষমেশ কোনো উপায় না পেয়ে আমি কুকুরছানাটিকে তুলে নিলাম হাতে।

কিন্তু কী আশ্চর্য! কুকুরছানাটির কান্না যেন সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল। বুঝতে পালাম কুকুরছানাটি আমাকে ওর বন্ধু মনে করেছে। মনে মনে আমিও ভীষণ খুশি হলাম। সেদিন সারা রাস্তা হেঁটেছি আর ভেবেছি বাড়িতে গিয়ে আমি কুকুরছানাটিকে কী কী খেতে দেব!

আম্মু আমার জন্য রোজ এক বাটি দুধ রেখে দিতেন! স্কুল থেকে ফিরে খাব। আম্মু বলতেন, দুধ খেলে নাকি বুদ্ধি বাড়ে! ভাবলাম, আজ সেই এক বাটি দুধ আমি এ কুকুরছানাকে খেতে দেব!

আহা! কত দিন কুকুরছানাটি বোধহয় মায়ের দুধ খায়নি! আমি কুকুরছানাটির মাথায় হাত বোলাতে লাগলাম আর আদর করতে লাগলাম। হঠাৎ মনে হলো, ওকে কুকুরছানা কুকুরছানা বলে ডাকা আমার কিছুতেই উচিত হচ্ছে না! তাই আমি ওর নাম রাখলাম ভুলু! আমার ভুলু বন্ধু!

সেদিন সারা রাস্তা ওকে ভুলু ভুলু বলে কত্ত যে ডেকেছিলাম। আমি খেয়াল করছিলাম আমি যখনি ওকে ভুলু বলে ডাক দিতাম ও সঙ্গে সঙ্গেই আমার দিকে কেমন অবাক চোখে থাকত আর ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করত। বুঝতে পারতাম, ভুলু নামটি ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছে!

বাড়িতে ঢুকতেই আম্মু বললেন, সেকি রে! ওই কুকুরছানাটিকে কোথায় থেকে ধরে আনলি শুনি? আমি আম্মুকে সব খুলে বললাম, আম্মু সব শুনে আমাকে তেমন কিছুই বললেন না! তারপর আমার জন্য রাখা এক বাটি দুধ আমি ভুলুকে খেতে দিলাম। এভাবে বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। ধীরে ধীরে ভুলু বড় হতে লাগল। ভুলু আর আগের মতো ক্যাউ ক্যাউ শব্দ করে ডাকে না, এখন সে রীতিমতো ঘ্যাউ ঘ্যাউ শব্দ করে ডাকে! আমি যখন পড়তে বসতাম ভুলু তখন আমার পাশে চুপটি মেরে বসে থাকত। আর আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকত। আমি তখন পড়া বাদ দিয়ে ভুলুর সঙ্গে কথা বলতাম, কী রে ভুলু? আমার মতো লেখাপড়া করবি? শুনে ভুলু কিছু বলত না শুধু ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করত। আমি যখন স্কুলে যেতাম ভুলুও চলে আসত আমার পিছু পিছু! আমি ভুলুকে এত করে বলতাম বাড়ি যেতে, তবু ও পিছু ছাড়ত না। তারপর যখন খুব জোরে ধমক দিতাম, তখন ভুলু থেমে যেত। কিন্তু তবু সে অনেকক্ষণ সেখানেই বসে থাকত। যতক্ষণ সে আমাকে দেখতে পেত, ততক্ষণ সেখানেই বসে থাকত। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে যেত।

এক দিন ঘটল এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা! আমি স্কুলে যাচ্ছিলাম কিন্তু ভুলুও আমার পিছু পিছু ছুটে আসছিল। আমি তো রোজ রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। ভুলুও আমার পিছু পিছু লাফিয়ে লাফিয়ে আসত। কিন্তু আমার স্কুলে যাওয়ার সময় প্রায় তিনটি ট্রেন আসা-যাওয়া করত সেই সময়ে। আমি ভুলুকে বাড়ি যেতে বললাম, কিন্তু ভুলু তবু আমার পিছু পিছুই আসতে লাগল। তারপর দিলাম এক ধমক। ধমক শুনে ভুলু সেখানেই চুপটি মেরে বসে পড়ল। দেখলাম, একটি ট্রেন বিদ্যুৎ গতিতে আমার দিকেই ছুটে আসছে। আমি তাড়াতাড়ি করে রেললাইন থেকে সরে পড়লাম, কিন্তু ভুলু?

ভুলু তো তখনো রেললাইনের ওপরই বসে আছে! ভুলু তো কিছুতেই সরে যাচ্ছে না! আমার কিছু ভাবার আগেই ট্রেনটি অনেক ধুলোবালি উড়িয়ে ভুলুকে অতিক্রম কর চলে গেল!

আমি দেখলাম, রেললাইনের ওপরে ভুলু নেই! আমি ছুটে এলাম ভুলুর কাছে! কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ! আমার ভুলুর ছিন্নভিন্ন দেহ এখানে-সেখানে পড়ে রয়েছে! আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম! আশপাশে আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না! কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না! আমি হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলাম। তারপর মনে হলো, একটা কিছু করতে হবে আমাকে। আমি এদিক-ওদিকে থেকে পলিথিন ব্যাগ কুড়িয়ে আনলাম। একটি আমার হাতে প্যাঁচিয়ে নিলাম। আর অন্য ব্যাগে আমার ভুলুর ছিন্নভিন্ন শরীরের মাংসগুলো পলিথিন ব্যাগে জড়ো করলাম। তারপর সেই সরিষা খেতের পাশেই ভুলুকে আমি কবর দিলাম! সেদিন আর আমি স্কুলে যাইনি! মন খারাপ করে বাড়িতে চলে এসেছিলাম। আমার শরীরে ভীষণ জ¦র এসেছিল। আমি জ¦রের ঘোরেই ভুলু ভুলু বলে অনেক ডেকেছিলাম!

তারপর সুস্থ হয়ে আমি যত দিন ভুলুর কবরের পাশ দিয়ে স্কুলে গিয়েছি, তত দিনই আমার মন খারাপ হয়েছে। কখনো আমার চোখ দিয়ে টপটপ জল গড়িয়ে পড়েছে!

ভুলু আমার জীবনে ঠিক কী ছিল, ভুলুকে হারিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি! ভুলু আমার নিঃসঙ্গ জীবনে পরম এক বন্ধু ছিল! আজও রাস্তার কুকুরগুলোকে দেখলেই আমি থমকে দাঁড়াই আর ভাবি, এই কুকুরটিই বোধহয় আমার সেই ভুলু! পরক্ষণেই মনে হয়, আমি যে ভুলুকে আমার নিজ হাতে কবর দিয়েছি! আমার ভুল ভেঙে যায়! বুঝতে পারি, একটি ভুলুর জন্য আমি এখনো প্রায় সব কুকুরকেই ভুলু ভেবে ভেবে ভুল করি! আজও ভুল করছি!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close