ফারুক হোসেন সজীব

  ৩০ মার্চ, ২০১৯

সিজোফ্রেনিয়া

কদিন হলো তানিয়া বেশ হাসিখুশি! কারণ তানিয়ার নাকি নতুন একটি আপু আসবে! তাও আবার আম্মুর পেট থেকে? ভাবা যায়? তানিয়া দেখেছে, এ জন্য আম্মু আজকাল ভারী ভারী কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন! এখন তানিয়া আম্মুর পেটে কান পেতে শুনতে চাচ্ছে তার ছোট্ট আপুটার উপস্থিতি, মানে নড়াচড়া করছে কিনা! তানিয়ার এমন আচরণ দেখে তো আম্মু হেসেই বলেন, আরে আরে করে কী! করে কী! দেখো দেখি মেয়ের কান্ডজ্ঞান! শুনে তানিয়ার আব্বুও বলেন, শুনতে দাও, তানিয়া ওর বোনের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে, বোঝ না? কী ঠিক বললাম? আব্বু তানিয়াকে জিজ্ঞেস করেন। তানিয়া অবাক হয়ে আব্বু-আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে, আব্বু-আম্মুকে তো আগে কোনো দিন এতো হাসিখুশি দেখিনি? তাহলে কী তার নতুন ছোট্ট আপুটা জন্য তারা এত হাসিখুশি? তানিয়ার কেন যে মন খারাপ হয়ে যায়! সবচেয়ে বড় কথা হলো তানিয়া খেয়াল করেছে, এখন আর কেউ তাকে নিয়ে কোনো উৎসাহ দেখায় না! এখন সব উৎসাহ-ই তার ছোট্ট আপুকে ঘিরে, যে কিনা এখনো আম্মুর পেটের মধ্যেই আছে! তানিয়া আরো ভাবে, ছোট্ট আপুটি এলে আব্বু-আম্মু দুজনই বোধহয় তাকে ভুলে যাবে! এসব ভাবতেই তানিয়ার চোখে জল চলে আসে! তানিয়া এখনো তার আব্বু আম্মুর কাছেই দাঁড়িয়ে আছে অথচ তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না! কেউ তাকে নিয়ে কোনো কথাও বলছে না! অথচ আগে তো এমন হতো না! তবে কী আব্বু-আম্মুর কাছে তার নিজের গুরুত্ব কমে গেছে? তানিয়া আর আব্বু-আম্মুর কাছে থাকে না, সে দৌড়ে চলে যায় পাশের রুমে, গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে চোখের জল ফেলে! ভীষণ কষ্ট হয়! আব্বু-আম্মু কীভাবে তাকে এতটা পর করে দিলেন? সে কী এমন করেছে? কই সে তো কোনো অপরাধ করেনি! তাই তানিয়া স্থির করেছে সে আব্বু-আম্মুর কাছে বেশি যাবে না! আব্বু-আম্মুর সঙ্গে প্রাণ খুলে কথাও বলবে না! সারা দিন সে একা একাই খেলা করবে! এসব ভাবতেই সে কষ্টে দৌড়ে বেলকুনিতে চলে যায় আর কার সঙ্গে যেন বিড়বিড় করে কথা বলতে থাকে! অথচ তার পাশে কেউ নেই!

এভাবেই কেটে যাচ্ছিল তানিয়ার দিন-রাত! আহা! মাঝে মাঝে একটু আদর পাওয়ার জন্য সে আব্বু আম্মুর কাছে দৌড়ে ছুটে যেত, কিন্তু গিয়ে দেখত, আব্বু-আম্মু ছোট্ট আপুটাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে! আশ্চর্য! তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না! তানিয়া আর বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না! যদিও মাঝে মাঝে আব্বু-আম্মু তানিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চান কিন্তু কী আশ্চর্য! সে কথাগুলোও তার ছোট্ট আপুকে নিয়েই! আব্বু-আম্মু আপুটার একটি সুন্দর নামও রেখে ফেলেছেন- তানহা! ভীষণ মিষ্টি নাম! আব্বু-আম্মু আবার তানিয়াকেই বলেন কি না, নামটি অনেক সুন্দর, তাই না? শুনে তানিয়া কিচ্ছুটি বলে না! তার ভীষণ কান্না পেয়ে যায়! আব্বু অফিস থেকে ফিরেও তানিয়াকে আর কোলে তুলে আদর করেন না! আম্মুও তানিয়াকে তেমন সময় দেন না! সারাক্ষণ শুধু তার ছোট্ট আপুকে নিয়ে চিন্তা করে সময় দেন! এভাবে বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। হঠাৎ একদিন হলো এক বিপত্তি! আম্মুকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। তার কিছুক্ষণ পরেই তার ছোট্ট আপুটির জন্ম হলো! তাই দেখে তো সবাই মহাখুশি! সবাই ছোট্ট আপুকে কোলে তুলে চুমু খাচ্ছেন! কেউ কেউ নতুন জামা-কাপড় কিনে দিচ্ছেন! আহা! তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না! তানিয়ার ভীষণ কান্না পেয়ে গেল! সে আর তাদের সামনে থাকতে পারল না, তাই সে দৌড়ে চলে গেল একটু দূরে! যেখানে মানুষ নেই! যেখানে সে একা! যখন ছোট্ট আপুকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। আব্বু-আম্মু যেন তানিয়াকে একেবারেই ভুলে গেলেন! এখন আর আগের মতো কেউ তাকে কাছে ডাকে না! ভালোবাসে না! এখন সে যেন সবার চোখেই বিরক্তের কারণ! এক দিন তানিয়ার হঠাৎ কী যেন হলো! এখন সে একা থাকতে চায়! আব্বু-আম্মুর সঙ্গে থাকতে চায় না! তার চোখের সামনে সে অদ্ভুত-অদ্ভুত কিছু একটা দেখতে পায়! তাই দেখে সে অবাক হয়ে যায়! সে একা একাই বিড়বিড় করতে থাকে! আজকাল মানুষকে সে একদমই পছন্দ করতে পারছে না! কী করে পছন্দ করবে? কেউ যে তাকে ভালোবাসে না! সে এখন আবার বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়েচেড়ে ইশারায় কার সঙ্গে যেন কথা বলছে! আব্বু-আম্মু জিজ্ঞেস করলেও সে কিচ্ছুটি বলছে না! সব চেয়ে বড় কথা তানিয়া এখন আর আব্বু-আম্মুকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না! আগে আব্বু-আম্মু তানিয়ার মুখে আদর করে ভাত তুলে খাওয়াতেন। আর এখন বলেন কি না নিজের হাতে ভাত খাও! তুমি বড় হয়ে গেছ! এসব কথা শুনতে তানিয়ার আর একটুও ভালো লাগে না! আজকাল তানিয়া অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করছে! চারদিকে এত এত অবহেলা তানিয়া আর কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না! রাতে সে ঘুমের ভিতরেও কান্নাকাটি করতে থাকে! স্কুলেও যেতে চায় না সে। পড়াশোনায় ভীষণ অমনোযোগী হয়ে গেছে সে! মানুষের সঙ্গ তার একটুও ভালো লাগে না! মানুষের সঙ্গে কথাও বলতে পারে না সে, তোতলাতে থাকে! কদিন হলো তানিয়াকে নিয়ে আশপাশের মানুষগুলো বলাবলি করছে তার নাকি জিনভূতে ধরেছে! তাই তানিয়াকে জোর করে গলায় অনেক তাবিজ কবজ পরিয়ে দিয়েছে সবাই! গলার সঙ্গে কালো সুতা আর এগুলো দেখে তানিয়া ভেবে, নিশ্চয় সবাই তাকে আলাদা আর এক ঘরে করে দিয়েছে! এখন আর সে কারো সঙ্গে কথাও বলে না! কারো কথাও শোনে না! কেউ তার নাম জিজ্ঞেস করলেও বলে না! সবাই তানিয়াকে এখন বোবা মেয়ে বলে হাসাহাসি করে! স্কুলের বন্ধুরাও তানিয়াকে বোবা বলে রাগায়! তানিয়ার আব্বু-আম্মু সব বুঝে এক দিন তানিয়াকে নিয়ে গেলেন একজন ভালো শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে! চিকিৎসক তানিয়ার গলায় তাবিজ কবজ দেখে তা খুলে ফেলতে বললেন! তারপর ডাক্তার আব্বু-আম্মুর মুখ থেকে সব কথা শুনে এবং বিভিন্ন উপসর্গ দেখে বললেন, যা ভেবেছি তাই! আব্বু-আম্মু ডাক্তারের কথা শুনে বললেন, কী ভেবেছেন বলুন! সিজোফ্রেনিয়া! মেয়েটি সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত! সিজোফ্রেনিয়া! মানে? আব্বু-আম্মু অবাক আর চিন্তায় পড়ে গেলেন। ডাক্তার বললেন, মেয়েটির হ্যালুসিনেশন, ডিলুশন! দুটিই হয়েছে! আর আপনারাও অনেক দেরি করে ফেলেছেন আসতে! এখন কোনো থেরাপিতেও কাজ হবে না! ওকে মেডিসিন চিকিৎসাই করতে হবে! সেই সঙ্গে ওকে বেশি বেশি টেক কেয়ার করতে হবে! আদর-ভালোবাসা দিতে হবে! ওকে বোঝাতে হবে আপনারা কেউ ওর শত্রু নয়! সবাই তার বন্ধু! শুনে তানিয়ার আব্বু-আম্মু বললেন, কী আমরা ওর শত্রু তানিয়া এটা ভাবে? শুনে ডাক্তার বললেন শুধু তাই নয়! তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু ভাবতে পারে! এমনকি তানিয়া আপনার কোলের শিশুটিকেও মেরে ফেলতে পারে! সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে এমনটাও দেখা গেছে! শুনে আব্বু-আম্মুর গলা শুকিয়ে গেল! ডাক্তার আব্বু-আম্মুকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, দেখুন রোগটি যেহেতু পরিবার থেকেই হয়েছে, তাই আপনাদের দায়িত্বই সব থেকে বেশি! ওকে বেশি বেশি আদর-ভালোবাসা দিতে থাকুন! মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে বেড়াতে যান। ছোট্ট বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে উৎসাহিত করেুন! আর এই ওষুধগুলো চলতে থাকুক! আম্মু তানিয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন! তাই দেখে তানিয়া কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকাল! তানিয়া এখন চিনতে চেষ্টা করছে সামনে যে দুজন বসে আছেন, তারা কী তার সেই আব্বু-আম্মু? যারা সারাক্ষণ তানিয়াকে আদর-ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতেন?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close