সাদিক আল আমিন

  ২৩ মার্চ, ২০১৯

রিজুর লাল সাইকেল

বন্ধু সজীবের লাল সাইকেলটা দেখে এক প্রকার হিংসেই হয় রিজুর। রোজ রোজ ওকে একা একা রিকশায় চেপে আসতে হয়। রিকশাগুলোও আবার এত আস্তে চালায় যে, রিজুর বিরক্তির সীমা চরমে পৌঁছে। ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে আবার দুষ্টু সজীব ওর রিকশাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে যায় জোরে সাইকেল হাঁকিয়ে। লাল সাইকেলে রোদ পড়লে চকচক করতে থাকে। সজীবের এঁকেবেঁকে স্টাইল করে সাইকেল চালানো রিজুকে হিংসেয় ফেলে। নিজের একটা সাইকেল না হলে যেন হয়-ই না। সেদিন বাসায় এসে বাবাকে অনেক অভিমানের সুরে বলে, বাবা, রোজ রিকশায় করে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে আমার একদম ভালো লাগে না। কেন ভালো লাগে না বাবা, কেমন যেন মেয়ে মেয়ে লাগে নিজেকে। মেয়েরা রিকশায় চড়ে স্কুলে যায়। আমি কি মেয়ে? বিরক্তি নিয়ে বলে রিজু। বাবা ওর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্নেহের স্বরে প্রশ্ন করে, ‘তা হলে তুই কী চাস বাবা? একটা লাল টুকটুকে রেঞ্জার সাইকেল। মনের ভেতরে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে প্রচন্ডভাবে পেয়ে বসে ওকে। কিন্তু তুই তো সাইকেল চালাতে পারিস না। স্কুলে যাবি কীভাবে? ‘সেটা আমি শিখে নেব। তুমি আগে কিনেই দাও তো! ছেলের এমন আবদারে না করতে পারে না রিজুর বাবা। সামনের মাসে বেতন পেলে ওকে একটা চকচকে সাইকেল কিনে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। রিজু অনেক খুশি হয়ে পরদিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের গল্প শোনাতে থাকে যে তার বাবা তাকে খুব সুন্দর একটা সাইকেল কিনে দেবে। বাসায় ঘুমোনোর সময়ও চোখবুজে সে সাইকেলের স্বপ্ন দেখতে থাকে। খুব সুন্দর একটা সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রিজু। বাতাসে তার চুল উড়ছে। এক প্যাডেলেই যেন খুব দ্রুতগতিতে ছুটছে তার সাইকেল! বাসের সঙ্গে পাল্লা দিতেও পারে এমন ক্ষমতা যেন!

বাবা রিজুকে সাইকেলটা কিনে দেওয়ার পর রিজু রোজ রোজ স্কুলে যায় আর ছুটি হলে হিরোর মতো চুল উড়িয়ে বাসায় ফেরে। চালানোটা ১০ দিনের মধ্যে শিখে যায় রিজু। পুরোনো রাইডার সজীবও এখন ওর সঙ্গে রেসে পাল্লা দিয়ে পারে না। ওর এই হঠাৎ উঠতি দেখে স্কুলে আর যাদের সাইকেল নেই, তারা হিংসে করতে থাকে। এক দিন এক ঘটনা ঘটে। রিজু প্রতিদিনের মতো সেদিনও স্কুলে হিরোর মতো এসে সাইকেলটা গ্যারেজে রেখে ক্লাস করতে যায়। ঠিকমতো ক্লাস করার পর ছুটি হলে গ্যারেজে এসে দেখে ওর সাইকেলটা আর আগের মতো দেখাচ্ছে না। সাইকেলের সিটটা ব্লেড দিয়ে কাটা, চাকায় কাঁটা ফোটানো, বেলটা পুরো উঠাও, চেইনটা ছিঁড়ে দুফাঁক হয়ে পড়ে আছে। সুন্দর চকচকে প্রিয় সাইকেলটার এই অবস্থা দেখে খুব হতাশ হয়ে পড়ে রিজু। এর মূল হোতা যে সজীব তা বুঝতে আর দেরি হয় না। স্কুলের সব ছেলেরা ওর অবস্থা দেখে হিহি করে হাসে। সবাই হিরো এখন জিরো বলে খ্যাপাতে থাকে। প্রচন্ড কান্না পেলেও কোনোমতে কান্না চাপিয়ে রাখে রিজু। প্রতিদিন খুব যতœ করা সাইকেলটার যে এই অবস্থা হবে বিশ্বাসই করতে পারেনা রিজু। বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, সব ওই বদমাশ সজীবের কাজ বাবা। আমার সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে পারে না বলেই ও এ রকম করেছে। কাল আমিও চুপ করে ওর সাইকেলের বারোটা বাজাবো। ভীষণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে রিজু। বাবা সরল হাসি হেসে বিজ্ঞদের মতো বলে, না রে বাবা। এ রকম কখনো করবি না। এ রকম করা পাপ। কেন বাবা? ও তো ঠিক-ই আমার সাইকেলটা নষ্ট করেছে। আমি করতে দোষ কোথায়। কেউ দোষ করলে তার ক্ষতি করে কোনো লাভ হয় না। পাল্টা সেও আবার তোর ক্ষতি করবে। বরং তার ভুলটা শুধরে দিয়ে ভালোবাসার সঙ্গে বরণ করলেই সে তার ভুল বুঝতে পারবে। বুঝলি বাবা? ‘বুঝলাম। কাল তুই সজীবের সঙ্গে একদম খারাপ ব্যবহার করিস না। উল্টো ভালো ব্যবহার করবি। দেখবি ও ঠিক লাইনে চলে এসেছে। আচ্ছা বাবা। ভদ্র ছেলের মতো জবাব দেয় রিজু। পরদিন স্কুলে এসে রিজুর ব্যবহারে সবাই অবাক। সবাই প্রত্যাশা করেছিল রিজু হয়তো এক ঘুসিতে সজীবের নাক ফাটিয়ে দেবে। অথবা সজীবের সাইকেলের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে? কিন্তু এ রকম কিছুই করল না রিজু। সবার সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে লাগল যেন কিছুই হয়নি। সজীবকে জোরে ডাক দিয়ে কাছে আসতে বলে। সজীব কী করবে, বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করতে করতে কাছে আসে। রিজু ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে, কেমন আছিস দোস্ত? সজীব রীতিমতো ভয়ে অস্থির। কাচুমাচু করতে করতে বলে, ‘এইতো ভালো। তুই-ই আমার সাইকেলটার বারোটা বাজিয়েছিলি, না? ইয়ে আরকি...মানে... হাহাহাহা। আরে বোকা এত ভয় পাচ্ছিস কেন? বন্ধু বন্ধুর বারোটা বাজাবে না তো কে বাজাবে? হাহাহাহা। রিজুর হাসিতে সজীব কিছুটা ভড়কে গেলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারে ওর নিষ্ঠুর কাজটার জন্য রিজু একদমই খ্যাপা না ওর ওপর। তাই একটু সহজ হয় সজীব? রিজু বলে, আমার বাবা বলেছে, যে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে? যে ক্ষতি করবে তার উপকার করতে। তা হলেই তার উচিত শিক্ষা হবে। তুই তো আমার ক্ষতি করলি সাইকেলটা নষ্ট করে। কিন্তু আমি তোর ক্ষতি না, বরং উপকার করব। তোর কালকের হোমওয়ার্কটা আমি করে দেব। কী বলিস? সজীব যেন নিজের ভুল বুঝতে পারে। ভীষণ অনুতপ্ত হয় ও। প্রচন্ড কান্না পায়। নিজেকে সামলাতে না পেরে সবার সামনে বোকার মতো ভ্যাত করে কেঁদে ওঠে রিজুকে বলে, আমারে মাফ করে দিস রে বন্ধু। আমি এ রকম আর কখনো করব না। কারো ক্ষতি করব না। উল্টো কেউ আমার ক্ষতি করলে উপকার করে তার ভুল ভাঙাব।

রিজু বড়দের মতো করে বলে,

‘সত্যি?

‘তিন সত্যি।

পুনশ্চ : সজীব রিজুর সাইকেলটার ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলেও রিজুর ঘোর আপত্তিতে ওকে আর সেটা দিতে হয়নি। রিজুর বাবা সাইকেলটা ঠিক করে দেওয়ার পর রিজু আর সজীব রোজ একসঙ্গে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়। রিজুর হিরোগিরিটাও কমে গেছে অনেকটা। তবে সেদিন ওর সাইকেলটা নষ্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে দুজনের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা অনেক গাঢ় হয়ে যায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close