আবদুস সালাম

  ২৩ মার্চ, ২০১৯

পাকুড়গাছের পেতনি

মাদারগঞ্জ গ্রাম থেকে শহরে যেতে হলে বেশখানিকটা পথ পাড়ি দিতে হয়। ওই পথটিই হলো শহরে যাওয়ার একমাত্র পথ। রাতবিরাতে ওই পথ ধরেই গ্রামবাসীকে চলাফেরা করতে হয়। ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে রাস্তাটি চলে গেছে। রাস্তার দ্ইু পাশে সারি সারি গাছ। মাঠের মধ্যে রাস্তার একপাশে বড় একটি পাকুড়গাছ রয়েছে। ওই গাছের নিচ দিয়েই সবাইকে চলাফেরা করতে হয়। দিনের বেলায়ও অনেকের গা ছম ছম করে। তাদের বিশ্বাস পাকুড়গাছে একটা পেতনি বাস করে। গাছটি নিয়ে গ্রামের লোকজন নানা কথা বলে। কেউ বলে আমার দাদা একবার রাতের বেলায় আসতে গিয়ে দেখে ওই গাছের নিচে সাদা শাড়ি পরে কে যেন বসে আছে। দাদা ভয় না পেয়ে একটা বিড়ি জ্বালায়। আর সঙ্গে সঙ্গে সে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। কেউ আবার বলে আমি এক দিন রাতের বেলায় দেখি পাকুড়গাছের ডালে আগুন জ্বলছে। করুণ সুরে কে যেন কথা বলছে। কিছ্ক্ষুণ পরে আবার শুনি পাখা ঝাপটানোর শব্দ। কেউ আবার বলে আমি তো অনেকদিন ধরেই রাতের বেলা শহর থেকে বাড়ি ফিরি। আমি তো কিছু দেখলাম না। যদি সত্যিই কোনো ভূত-টুট থাকে, তবে সে কারোর ক্ষতি করে না। ভালো ভূত। তবে যাই বলি না কেন, গ্রামবাসীদের যে ভূতটা ভয় দেখিছে তার প্রমাণ কিন্তু ভূরিভূরি রয়েছে। অতীতে সে অনেকের গায়ে ভর করেছে। ভূতেধরা অনেক রোগীকে বদর মুন্সি ভালো করেছে। তাই খুব প্রয়োজন না হলে গ্রামবাসীরা এখন পাকুড়গাছের পথ ধরে যাতায়াত করে না। শহরে কাজ থাকলে আগেভাগেই শেষ করে ফেলে। কারোর যদি দেরি হয়, তা হলে কয়েকজন মিলে একত্রে আসার চেষ্টা করে। যাতে পাকুড়গাছের ভূত আছর করতে না পারে।

মাদারগঞ্জের মকছেদ খুব সাহসী। সে ভূত-পেতনির ভয় করে না। দিনে-রাতে যখন-তখন সে পাকুড়গাছের নিচ দিয়ে যাতায়াত করে। যদিও এত দিন তার কোনো সমস্যা হয়নি। তবে কদিন আগে সে পেতনির খপ্পরে পড়ে। সেদিন মকছেদের মা তাকে একটা কাজে শহরে পাঠায়। শহরে যাওয়ার আগে তার মা তাকে বলে, ‘খুব তাড়াতাড়ি কাজ সেরে চলে আসবি। অযথাই দেরি করবি না। আর সাবধান! চলাফেরার পথে কোনো অপরিচিত লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবি না।’ মায়ের কথামতো মকছেদ শহরে গিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে সন্ধ্যার আগে আগে গ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয়। রাস্তায় কোনো লোকজন ছিল না। চারদিকে নিস্তব্ধ নীরবতা। দূর থেকে পাকুড়গাছের পেতনি দেখল মকছেদ একাকী হেঁটে আসছে। তার সঙ্গে কেউ নেই। পেতনি ভাবল ওকে একটু শায়েস্তা করা দরকার। এটাই উপযুক্ত সময়। অতীতে অনেকবার চেষ্টা করেছি কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হয়েছি। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যেভাবেই হোক মকছেদকে ভয় দেখাবেই। পেতনি নিজের চেহারা পরিবর্তন করে রাজকন্যার রূপ ধারণ করে। এরপর পাকুড়গাছের নিচে বসে বসে কাঁদতে থাকে।

মকছেদ দূর থেকেই তার কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। সে যখন গাছটির নিকটে আসে তখন দেখে গাছটির একপাশে সুন্দর একটা মেয়ে কাঁদছে। এতে মকছেদের মায়া হলো। আবার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও পেল। অসময়ে মেয়েটি এখানে এলো কী করে? মনের মধ্যে উদয় হওয়া এ রকম অনেক প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পায় না। ঠিক তখন মায়ের সাবধান বাণীও মনে পড়ে যায়। তাই কোনোদিকে মন না দিয়ে সোজা হাঁটা দেয়। তখন পেতনি নরম সুরে মকছেদকে উদ্দেশ্য করে নাকে নাকে বলে, ‘কে গো তুমি? আমাকে একটু সাহায্য করো না। আমি খুব বিপদে পড়েছি। দয়াকরে আমাকে একা ফেলে যেও না। একটু সাহায্য করো না গো...।’

কী হয়েছে তোমার?

আমি পায়ে ব্যথা পেয়েছি। আমি হাঁটতে পারছি না। আমার হাতটা ধরে তুলে দিলেই হাঁটতে পারব।

সে না হয় দিলাম। তোমার বাড়ি কোথায়? তুমি কোথায় যাবে?

আমার বাড়ি শহরের শেষ মাথায়। এদিকে একটু ঘুরতে এসেছিলাম। বাড়ি ফেরার পথে পায়ে ব্যথা পেয়েছি। তাড়াতাড়ি না যেতে পারলে আব্বা-মা ভীষণ বকা দেবে।

তার কথাগুলো শুনে মকছেদের মায়া হলো। মকছেদ মেয়েটির নিকটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেতনি চেহারা পরিবর্তন করে কুৎসিত ডাইনির রূপ ধারণ করে। এতে মকছেদের পিলে চমকে যায়। কোনো দিশা না পেয়ে একটা দৌড় দেয়। কিন্তু সে মুক্তি পায় না। পেতনি তার ওপর ভর করে।

রাতের বেলায় মকছেদ বাড়ি ফিরলে তার মা তাকে খেতে দেয়। দ্রুত সে ভাতগুলো খেয়ে ফেলে। তার চোখ-মুখ এবং অস্বাভাবিক আচরণ দেখে মায়ের সন্দেহ হয়। মা বুঝতে পারে, নিশ্চয় কোনো জিন তার ওপর ভর করেছে। সকালবেলায় মকছেদের বাবা বদর মুন্সিকে ডেকে আনে। মকছেদের জিনে ধরার ঘটনাটি সারা গ্রামে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাকে একনজর দেখার জন্য প্রতিবেশীরা ভিড় করে। যথাসময়ে ওঝা বাড়িতে চলে আসে। উপস্থিত সকলে ওঝাকে অনুরোধ করে একটা স্থায়ী সমাধান বের করার জন্য। যাতে ভবিষ্যতে কোনো জিন কারোর ওপর ভর করতে না পারে। ওঝা সকলের সামনে জিনকে জিজ্ঞাসা করল। তোর নাম কী? তুই কোথায় থাকিস?

: আমার নাম পেতনি। আমি পাকুড়গাছে থাকি।

: ওখানে কত দিন ধরে আছিস?

: দুই বছর ধরে আছি। আগে সৌদি আরবের মরুভূমিতে থাকতাম।

: তোর বয়স কত?

: তিনশ বছর।

: তুই এর ওপর ভর করলি কেন?

: ওর প্রতি আমার ভীষণ রাগ। আমি এক দিন দেখি সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোবরের ওপর প্রশ্রাব করছে। আমি আরো এক দিন দেখেছি সে মৃত পশুপাখির হাড়ের ওপর প্রশ্রাব করছে। এজন্য আমি ওকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ভর করেছি।

: ঠিক আছে ও আর এ রকম কাজ করবে না। তুই এখন চলে যা।

: না, আমি কিছুতেই যাব না।

ওঝা মকছেদের মাকে একটা বোতল আর বাটিতে কিছু সরিষার তেল নিয়ে আসতে বলে। ওঝা দোয়া পড়ে সরিষার তেলে তিনবার ফু দেয়। তারপর সেই তেলপড়া যেই মকছেদের মুখের ওপর ছিটিয়ে দেয় আর মকছেদ চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ওঝা পেতনিকে বলে, ‘তুই যদি বাঁচতে চাস তা হলে এক্ষুনি চলে যা। যাওয়ার সময় গাছের একটা ডাল ভেঙে যাবি। আর কোনো দিন আসবি না। আর যদি না যাস, তা হলে তোকে বোতলের মধ্যে ভরে রাখব।’ পেতনি ওঝার কোনো কথায় কর্ণপাত করল না। শেষ পর্যন্ত ওঝা বাধ্য হয়ে পেতনিকে বোতলের মধ্যে ভরে রাখল। মকছেদ তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ওঝা গ্রামবাসীদের বলে, এই বোতলটা নদীর মাঝে ফেলে দেবে। ওঝার কথামতো তারা বোতলটি নদীর মাঝখানে ফেলে দিল।

মকছেদের জ্ঞান ফিরলে ওঝা সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘এখন আর তোমাদের কোনো ভয় নেই। তোমরা নির্ভয়ে চলাফেরা করবে। যেখানেই যাবে আল্লাহকে স্মরণ করবে। তার ওপর ভরসা করে সাহসের সঙ্গে পথ চলবে। কেউ তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। তিনিই তোমাদের রক্ষা করবেন। জিন আছর করলে বা শয়তানের কুমন্ত্রণা অনুভব করলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে। আর একটা কথা মনে রাখবে। আল্লাহ জিনদের আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তিনি যেমন ফেরেশতা, মানুষ সৃষ্টি করেছেন; তেমনি সৃষ্টি করেছেন জিন। জিনরা শূন্যে উড়ে বেড়ায়। মানুষের রূপ ধরতে পারে। তাদের বিবেক, বুদ্ধি, অনুভূতি শক্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে আছে ভালো জিন ও মন্দ জিন। জিনরা অন্ধকার ও নির্জন স্থানে থাকতে ভালোবাসে। মন্দ জিন ময়লা-আবর্জনা নোংরা পরিবেশে থাকে। হাড় ও গোবর ওদের খাদ্য। তাই তোমরা কখনো ওগুলোর ওপর মলমূত্র ত্যাগ করবে না। আর হ্যাঁ, তোমরা যারা ছোট, তারা অবশ্যই বাবা-মায়ের কথা শুনবে। গ্রামবাসীরা ওঝার উপদেশ মেনে চলাফেরা করে। এরপর থেকে তাদের আর কোনো সমস্যা হয়নি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close