মালেক সরদার

  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

শখের পাতিল

সকাল থেকে নবনী তার পড়ার টেবিলে বসে আছে। বার্ষিক পরীক্ষা চলছে, আজকেই শেষ পরীক্ষা। তবু প্রচন্ড মন খারাপ। বাবা একটু পর পর তার কাছে এসে পড়ার তাগাদা দিচ্ছেন। কিন্তু কোনোভাবেই তার পড়তে ইচ্ছা হয় না। গতকাল রাতে ছোট মামা এসেছেন তাদের সবাইকে নিয়ে যেতে। আজ সকালেই নবনীর আম্মু আর ছোট ভাই স্বাধীন চলে যাবে মামাবাড়ি। পরীক্ষার কারণে নবনী যেতে পারছে না। মামাবাড়িতে পৌষের মেলা বসেছে। কয়েক দিন ধরে মেলা চললেও আজকেই শেষ দিন। কিন্তু নবনীর পরীক্ষা শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে যাবে। পরীক্ষা শেষ করে সে কি মেলায় পৌঁছাতে পারবে?

সকাল ১০টা নাগাদ ছোট মামা স্বাধীন আর আম্মুকে নিয়ে চলে গেলেন। তার ইচ্ছা ছিল এবার ছোট মামার সঙ্গে সবাই মামাবাড়ি যাবে। এসব কথা ভেবে তার রাজ্যের মন খারাপ। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাবা নবনীকে নিয়ে রওনা হবেন। তার বাবা স্কুলশিক্ষক। বাবার স্কুলেই নবনী পড়াশোনা করছে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করার কিছুদিন পরেই ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এবার তৃতীয় শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠবে নবনী। কিন্তু তার সে আনন্দটা যেন মøান হয়ে গেছে মেলায় না যেতে পারার দুঃখে।

বিকেল ৩টার সময় নবনীর পরীক্ষা শেষ হলো। খাতা জমা দিয়ে সে বাবার জন্য স্কুল মাঠের সামনের বাঁশের মাচায় বসে অপেক্ষা করছে। তার বাবা অফিসের কাজ শেষ করে বের হতে আরো ৩০ মিনিট চলে গেল। বাবার সঙ্গে স্কুল থেকে দ্রুত বাড়ি ফিরল নবনী। ব্যাগ মোটামুটি গোছানোই ছিল। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়ল তারা। বাবার সাইকেলের পেছনে চুপচাপ বসে আছে সে। প্রায় আট মাইল পথ। পাঁচ মাইল যাওয়ার পর একটা ছোট নদী। কী যে সুন্দর সে নদীটা! কাচের মতোই স্বচ্ছ সেই নদীর জল। নবনীর খুব ভালো লাগে নদীটা। নদী পার হতে হয় নৌকায়। তারপর খানিকটা পথ গেলেই মামাবাড়ি। মামাবাড়ির উঠোন থেকেই দেখা যায় মেলার আয়োজন। পাঁচ মিনিট হাঁটলেই যাওয়া যায় মেলায়। এসব কথা মনে করে একটু পরপর সে বাবাকে তাগাদা দিচ্ছে সাইকেল জোরে চালানোর জন্য।

কিছুদূর যেতেই ঘটল বিপত্তি। সাইকেলের চেইন গেল ছিঁড়ে। সম্ভবত জোরে চালাতে গিয়েই এমনটা হয়েছে। নবনী সাইকেল থেকে নেমে কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা এখন কীভাবে যাব বাবা? আমরা বোধহয় এবার মেলায় যেতে পারব না!’ বাবা তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘এই তো আর খানিকটা পথ! আমরা ঠিকই চলে যাব। আশপাশে কোথাও সাইকেল ঠিক করার মতো কোনো উপায়ও তো নেই রে মা! বাকিটা পথ হেঁটেই যেতে হবে।’

নবনী বাবার আঙুল ধরে হাঁটতে লাগল। নদীর ঘাটে গিয়ে নৌকায় উঠল তারা। প্রতিবার নদী পার হওয়ার সময় নদীর পানির দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে নবনী। বাবাকে নদী নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করে। এ নদীর নাম কী, কোথা থেকে এসেছে ইত্যাদি। কিন্তু এবার বড্ড চুপচাপ সে, কোনো কথা বলছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নৌকায়। নদী পার হয়ে বাবার সঙ্গে আবারো হাঁটতে শুরু করল নবনী। একটুর পর পর সে বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘বাবা আর কতক্ষণ লাগবে?’

‘এই তো প্রায় চলেই এসেছি; আর একটু।’ প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মেলা থেকে লোকজন বাড়ির দিকে ফিরতে শুরু করেছে। বড়দের সঙ্গে সঙ্গে নবনীর বয়সী ছেলে-মেয়েরাও দল বেঁধে আসছে মেলা থেকে। কারো হাতে হরেক রঙের বেলুন, কারো হাতে বাঁশি, কারো হাতে ঘুড়ি আবার কারো হাতে খাবার। এক পিচ্চি মিঠাই খেতে খেতে ফিরছিল। মিঠাই খেতে গিয়ে রসে তার জামা ভিজে গেছে। এটা দেখে নবনী ফিক করে হেসে উঠল। আরেকটু এগিয়ে যেতেই নবনীর আবার মন খারাপ হয়ে গেল। তার বয়সী এক মেয়ে শখের পাতিল নিয়ে ফিরছে। গত বছরও নবনী শখের পাতিল নিতে পারেনি। যেদিন সে মেলায় যায় সেদিনই পাতিল শেষ হয়ে গিয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও পাওয়া যায়নি। মাটির তৈরি পাতিলের গায়ে ফুল, পাখি, চাঁদ-তারা, হাতি, ঘোড়াসহ বিভিন্ন ধরনের আঁকাআঁকি করা থাকে। দেখতে খুবই সুন্দর লাগে তার। মেলায় অনেক রকম জিনিসপত্র পাওয়া গেলেও শুধু শখের পাতিল নিতে এবার নবনী মেলায় যাওয়ার যত আগ্রহ। কিন্তু এবারও বোধহয় নবনীর শখের পাতিল নেওয়া হবে না। এসব কথা ভেবে জামার হাতা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সে বাবার সঙ্গে যাচ্ছে।

সন্ধ্যার কিছু পরে নবনী তার মামাবাড়ি পৌঁছাল। স্বাধীনকে কোলে নিয়ে আম্মু পথ চেয়ে বসে আছেন। আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আসতে এত দেরি হলো কেন? তোর মামা তোর জন্য অপেক্ষা করে একা একাই মেলায় গিয়েছিলেন।’

নবনী মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমি রঙিন পাতিল নেব আম্মু। আমাকে পাতিল কিনে দাও। আমায় মেলায় নিয়ে চল ?তুমি। ধুর বোকা মেয়ে, এ সময়ে কি আর মেলায় কেউ যায়! মেলা তো শেষ। কান্নাকাটি বন্ধ কর, তোর শখের পাতিল আছে। একথা বলতেই নবনীর ছোট মামা ঘর থেকে দুটো বাহারি রঙের পাতিল তার সামনে নিয়ে এলেন।

‘এই যে নবনী তোমার শখের পাতিল, আমি কিনে রেখেছি। পছন্দ হয়েছে? ভেজা চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠল নবনীর। চোখেমুখে অন্য রকম উচ্ছ্বাস। আনন্দে ঠোঁট জোড়া কাঁপছে তার। ছোট মামার হাত থেকে শখের পাতিল দুটো নিয়ে বুকে জড়িয়ে

ধরল সে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close