হামীম রায়হান
কাগজের ফুল
আজ হাসানের স্কুল বন্ধ। তাই মা ভাবলেন, হাসানকে একটু দেরি করে ঘুম থেকে ডাকবেন। অন্যদিন হাসানকে বারবার ডাকেও ঘুম থেকে তোলা যায় না, আজ রাস্তায় মিছিলের গান শুনে উঠে গেল। বিছানায় বসে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিসের গান?’ বাবা বলেন, ‘প্রভাতফেরী হচ্ছে।’ ‘আমি দেখব’ বলে হাসান দৌড়ে গেল জানালার ধারে। বাবাও গেল পেছন পেছন। হাসান দেখে কিছু লোক খালি পায়ে, হাতে ফুল নিয়ে, গান গেয়ে এগিয়ে চলছে। হাসান বাবাকে বলল, ‘বাবা, প্রভাতফেরী করে ওরা কই যায়?’
‘ওরা সবাই শহীদ মিনারে যায়।’
‘শহীদ মিনার কী বাবা?’
‘শহীদদের স্মৃতির স্মরণে যে মিনার, তাকে শহীদ মিনার বলে।’
‘শহীদ কারা?’
‘সত্য ও ন্যায়ের জন্য যারা প্রাণ বিলিয়ে দেয় তারাই শহীদ।’
‘তারা শহীদ হয়েছেন কেন?’
‘আমরা যে আজ বাংলা ভাষায় কথা বলছি, এক দিন কিছু শয়তান এসে বলল, আমরা এ ভাষায় কথা বলতে পারব না, এ ভাষা ভুলতে হবে। তখন আমাদের কিছু সাহসী নায়ক বলল, ‘না, আমরা এ ভাষায় কথা বলব, এটা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলাই হবে আমাদের মাতৃভাষা।’ এ কারণে তারা যখন মিছিল বের করলে শয়তানরা মিছিলে গুলি করে। এতে মারা যায় অনেক ছাত্র। তাদের জীবনের বিনিময়ে আমরা এ বাংলা ভাষা পেলাম। তাই তাদের স্মরণে এ শহীদ মিনারে যাওয়া।’
‘মাতৃভাষা কী?’
‘জন্মের পর তোমার মায়ের মুখে প্রথম যে ভাষা তুমি শুনেছ, তাই-ই মাতৃভাষা।’ হাসান এবার অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তারা আমার মায়ের মুখের ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে! আমিও যাব শহীদ মিনার।’ বাবাও ভাবছিলেন এবার হাসানকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাবেন। তাদের বাসা মুন্সেফবাজার। হাসানের স্কুল ডাকবাংলো মোড়। স্কুলে যাওয়া-আসা ছাড়া হাসান তেমন বের হয় না। স্কুলে যাওয়ার পথে আদালতের সামনেই শহীদ মিনার। হাসান কয়েকবার দেখেছে, কখনো একুশে ফেব্রুয়ারিতে যাওয়া হয়নি।
তাই বাবা বললেন, ‘রেডি হয়ে নে।’
হাসান দৌড় দেয় প্রস্তুত হতে। কিছুক্ষণ পর খালি পায়ে, পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এল হাসান। বাবা সবচেয়ে বেশি অবাক হলেন যখন হাসানের হাতে একটা কাগজের ফুল দেখলেন। বাবা বললেন, ‘এটা কবে বানালে?’
‘এ তো কিছুক্ষণ আগে। আমাদের বিদ্যালয়ের রাশেদ স্যার শিখিয়েছেন।’ ‘আমরা তো দোকান থেকে সত্যিকারের ফুল কিনব।’ ‘না, আমি এই ফুলটাই নেব। শহীদরা যেমন জীবন দিয়ে, কষ্ট করে আমাদেরকে ভাষা দিল, আমিও অনেক কষ্ট করে এ ফুল বানাইছি।’ বাবা দেখলেন হাসানের চোখেমুখে এক অন্যরকমের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তিনি তো এই চেয়েছেন। হাসানের হাতে কাগজের ফুলটি নিয়েই একটা প্রভাতফেরির সঙ্গে যেতে লাগল ওয়াপদার রোড হয়ে শহীদ মিনারের দিকে।
"