ফারুক হোসেন সজীব

  ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বইমেলার প্ল্যান

বইমেলার কথা শুনলেই রাজমণি যেন একটু নড়েচড়ে বসে। বাড়তি কিছু টাকা পাওয়ার জন্য সে বিভিন্ন ফন্দি বের করে অবার আম্মুর কাছে বায়নাও ধরে। যদি আম্মু না দেন তাই কিছুটা মিথ্যাও সে যোগ করে তার কথার মধ্যে। রাজমণি আম্মুকে বলে, টিফিনের জন্য কিছু টাকা বাড়িয়ে দিও তো! রোজ রোজ শুধু বিশ, ত্রিশ টাকা করে দাও! আজকাল বিশ, ত্রিশ টাকায় কিছু হয় নাকি?

আম্মু রাজমণির দিকে অবাক চোখে তাকায় তারপর বলে মতলব কি তোমার? এত দিন তো বিশ টাকাতেই ভালোই চলত আর এখন বলছ টাকা বাড়িয়ে দিতে? রাজমণি আমতা আমতা করে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে, আসলে হয়েছে কী আম্মু, আমাদের সঙ্গে একটি গরিব মেয়ে পড়ে মাঝে মাঝে ওকে সঙ্গে নিয়েই তো লাঞ্চ করি, তাই ..! শুনে আম্মু নীরব হয়ে যান এবং মনে মনে খুশিই হন! পরক্ষণেই রাজমণি ভাবে ইস! এভাবে মিথ্যা বলার কী দরকার ছিল, বললেই তো হতো আসছে বইমেলায় সে নতুন বই কিনবে, তাই এখন থেকেই সে টাকা জমাচ্ছে। আবার ভাবল, যদি আম্মু একাডেমিক বইগুলোর পাশাপাশি অন্য বইগুলো পড়তে না দেন, যদি বলেন কিনতে হবে না বই! তা হলে যেসব প্ল্যান তার ভেস্তে যাবে।

তাই বইমেলা আসা পর্যন্ত সে কাউকে বইমেলায় নিজের বই কেনার কথা বলবে না! বলে প্ল্যান করল।

এভাবে জমিয়ে-জমিয়ে রাজমণির বেশ কিছু টাকা জমে গেল। রাজমণি কম দামি নতুন বইগুলোর কালেকশন দেখতে লাগল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। কিন্তু সব বই-ই যেন নবীন লেখকদের বই। ভাবল, নবীন লেখকদের বই কেমন হবে, যদি ভালো না হয়? তাহলে তো তার সব টাকা-ই মাটি হয়ে যাবে। এত দিনের কষ্টের টাকাটা জলে যাবে! তবে বেছে বেছে রাজমণি তিনটি বইয়ের তালিকা করে ফেলল। ভাবল, ওই বইগুলোই কিনবে সে!

দেখতে দেখতে বইমেলা এসে গেল, রাজমণি স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথে তার প্রিয় বান্ধবী পিয়াংকাকে বলল, কাল তো বইমেলার প্রথম দিন, চল ঘুরে আসি! এবার বইমেলাতে অনেক ভালো ভালো বই এসেছে প্রবীণ লেখকদের পাশাপাশি নবীন লেখকদেরও। বইগুলোর রিভিউ পড়েছি বেশ ভালো লেগেছে।

শুনে পিয়াংকা বলল, কী বলছিস রাজমণি! তুই তো দেখছি এখনো সেই প্রাচীন যুগেই পড়ে আছিস! আজকাল কেউ বই পড়ে নাকি! এখন ভার্চুয়াল জগৎ সব বই তো ইন্টারনেটেই পাওয়া যায়, তাও মাত্র কয়েক মেগাবাইটের বিনিময়ে। আর শুধু শুধু কষ্ট করে বইমেলাতে যাবার কি দরকার? ওমন হইহুল্লোর, ভিড় বাট্টা, মানুষের চেঁচামেচির কোনো মানে হয়? রাজমণি পিয়াংকার কথা শুনে খুব কষ্ট পেল। রাজমণি ভেবেছিল, পিয়াংকাও তার মতই ভীষণ বইপ্রেমী, বই পড়তে পছন্দ করে। কারণ ফেসবুকে ওর প্রোফাইল ফটো পর্যন্ত বইয়ের ছবি দেওয়া। আর কথায় কথায় পিয়াংকা তো এ বই-ও বইয়ের বাণীও আওড়ায়! তাহলে?

রাজমণি বলল, তার মানে তুই বইমেলায় যাবিনা বলছিস?

রাজমণি রাগ করে বলল, ঠিক আছে যেতে হবে না, আমি একাই যাব। বলেই রাজমণি বাসায় চলে এল।

রাজমণির যেন জেদ চেপে বসেছে। পরক্ষণেই ভাবে, কিন্তু একা একা বইমেলাতে যাওয়া তো একদমই নিরাপদ না। আজকাল তো কত কিছুই ঘটছে। তাহলে উপায়?

রাজমণি উভয় সংকটে পড়ল,

তাহলে কি সে রকমারিতে বই অর্ডার দেবে?

তারপর কি ভেবে সে সিদ্ধান্তও পরিবর্তন করল, কারণ আজকাল অনলাইনের কোনো কিছুতেই যেন তার বিশ^াস নেই! আর তাছাড়া নিজের হাতে নেড়েচেড়ে বই কেনার যে কী আনন্দ রাজমণি গত বইমেলায় সেটা উপলব্ধি করেছে। সব কিছু ভেবে রাজমণির ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল।

প্রতিদিন সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে-ই রাজমণি পড়তে বসে, কিন্তু আজ যেন তার পড়তে একটুও ভালো লাগছে না! বইমেলাকে সামনে রেখে তার এত-এত পরিকল্পনা ছিল তার কোনটাই যেন পূরণ হল না! কিছুক্ষণ পরেই রাজমণির আব্বু বাসায় এলেন। রাজমণি আব্বুর পায়ের শব্দ পেয়ে বেশ জোরে জোরে পড়তে লাগল। আব্বু প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় এসেই রাজমণির রুমে প্রবেশ করেন। রাজমণি আব্বুর মুখের দিকে তাকাল, আব্বু হেসে বলল, রাজমণি মামুনি! কাল কি তোমার স্কুল আছে?

হ্যাঁ আব্বু কিন্তু কেন?

তেমন কিছু না! তোমাকে নিয়ে বইমেলাতে যাওয়ার প্ল্যান করছিলাম। আসলে প্রতি বছরেই বইমেলার শুরুর দিকেই যাই তো! অনেক দিনের পুরনো অভ্যেস কিন্তু কাউকে পেলাম না! তুমি গেলে তোমার আম্মুও হয়ত যেত! শুনে রাজমণি যেন লাফিয়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরল। আব্বু কিছুটা অবাক হয়ে বলল, আরে-আরে এত বড় মেয়ে করে! করে কী!

রাজমণি আনন্দে মুখে হাসি এনে বলল, আব্বু জানো, আমি বইমেলাতে যাব বলে সেই কবে থেকেই টিফিনের টাকা জমিয়ে রেখেছি, নতুন নতুন বই কিনব বলে, কিন্তু পিয়াংকা বলে কিনা যাবে না!

শুনে কী যে কষ্ট হচ্ছিল, ভাবছিলাম, এবার বইমেলাতে হয়তো যাওয়াই হবে না!

আব্বু অবাক হয়ে রাজমণিকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন আর বললেন, তুমি আমার মেয়ে! আর আমার মেয়ে হয়ে বইমেলাতে যাবে না তা কি করে হয়! কাল মেলার প্রথম দিনেই আমরা সবাই বইমেলাতে যাব। নতুন নতুন বই কিনব, কত টাকাই তো এখানে-ওখানে খরচ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বই অমূল্য সম্পদ! সারা জীবন আমাদের পাশেই থাকবে!

হঠাৎ আম্মু পাশ থেকে বললেন, বাবা-মেয়ের বই কেনার প্ল্যান হচ্ছে আর আমি বুঝি বাদ?

আরে তুমি বাদ পড়বে কেন? তবে যদি দু একটা শাড়ি আগে থেকেই কম কিনলে সেই টাকা দিয়ে এখন ভালো ভালো বই কিনতে পারতে! শুনে রাজমণি হেসে অন্যরুমে চলে গেল! অন্যরুম থেকেও রাজমণি শুনতে পাচ্ছে আব্বু-আম্মুকে বলছেন, তোমাকেও কিনে দেব! আম্মু হেসে বললেন, কেন আমার বুঝি টাকা নেই! তোমাকেও বই গিফট করবো দেখ! ওঘর থেকে আব্বু-আম্মুর কথা শুনে রাজমণির কী যে ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে, এত আনন্দ তার জীবনে আগে কোনো দিন আসেনি!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close