আরাফাত শাহীন

  ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯

আশ্রয়

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই রবিনকে রোজ কাজে বের হতে হয়। রবিন ফুটপাতে ঘুমায়। এটাই তার ঘরবাড়ি। এখানেই তার আশ্রয় জোটে। এই আশ্রয়ে সে শুধু একা নয়, আরো বেশ কয়েকটা ছেলে আছে যারা রোজ সকালে রাস্তায় বোতল কুড়াতে বেরোয়। এটাই ওদের কাজ। সারা দিন প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে দিন শেষে বিক্রি করে, যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই ওদের কোনো মতে দিন পার হয়ে যায়। সবার সঙ্গে মিলেমিশে রবিন এখানে বেশ শান্তিতেই দিন অতিবাহিত করে।

অন্য ছেলেদের তুলনায় রবিন একটু আগেই বেরিয়ে পড়ে। সবার চেয়ে আগে বেরোতে পারলে যদি কয়েকটা বোতল বেশি পাওয়া যায়! আবার ফেরার সময়ও রবিন সবার পরে ফেরে। সারা দিন এত পরিশ্রম করার পর রাতে কোনো মতে মাথা গোঁজার জন্য ফুটপাতের এই জায়গাটিতে এসে আশ্রয় নেয়। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিতেই সে শান্তির রাজ্যে হারিয়ে যায়।

রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে রবিন। এখনো পুরোপুরি সকাল হয়নি। রাস্তায় তাই লোকজনের চলাচলও তেমন শুরু হয়নি। কিছু মানুষ কেডস আর ট্রাউজার পরে দৌড়াচ্ছে। এই লোকগুলোর সঙ্গে ওর প্রতিদিনই দেখা হয়। রবিন ভেবে পায় না এই লোকগুলো প্রতিদিন এভাবে দৌড়ায় কেন! মাথায় সমস্যা আছে হয়তোÑ রবিন মনে মনে ভাবে। ওর নিজের অবশ্য এভাবে দৌড়ানো লাগে না। সারা দিন তো সে দৌড়ের ওপরই থাকে!

‘এই রবিন, এদিকে আয় তো!’

রাস্তার পাশের চায়ের দোকানদার মতি মিয়া রবিনকে ডাক দেয়। মতি মিয়ার ডাক শুনে সে মনে মনে খুশি হয়ে ওঠে। এর অর্থ হলো, এখন রবিনকে এক বালতি পানি এনে দিতে হবে। বিনিময়ে মতি মিয়া রবিনকে এক কাপ চা আর একটা বিস্কুট খাওয়াবে। দুপুর পর্যন্ত তার এতেই চলে যাবে। তারপর দিন শেষে একদম রাতে এসে আবার খাবে।

রবিন মতি মিয়াকে আরেকটা কারণেও পছন্দ করে। সবাই রবিনকে টোকাই বলে ডাক দেয়। একমাত্র মতি মিয়াই তাকে নাম ধরে ডাকে। রবিন পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়।

‘পানি আনতে হবে নাকি চাচা?’

রবিন প্রশ্ন করে।

‘না। পানি আনা লাগবে না। আমি এনে রেখেছি।’

মতি মিয়ার কথা শুনে রবিনের মন খারাপ হয়ে যায়। তাহলে চা আর বিস্কুট আজ খাওয়া হলো না!

মতি মিয়া রবিনের মনের কথা বুঝতে পারে। সে হেসে ফেলে। তারপর রবিনের দিকে ধোঁয়া ওড়া এক কাপ চা আর একটা বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে নিজেও তার পাশে এসে বসে। রবিন অবাক হয়ে যায়। মতি মিয়া আর যাই হোক একটা দোকানের মালিক। রবিনকে পাশে বসিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা কি মতি মিয়ার শোভা পায়! বুকটা ভরে যায় রবিনের। মন থেকে মতি মিয়ার জন্য দোয়া বেরিয়ে আসে।

চা আর বিস্কুট শেষ করে রবিন আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। আজ একটু দেরি হয়ে গেল বৈকি। তবে তাতে তার মনে কোনো দুঃখ নেই। কিছু ভালো মানুষ আজও সমাজে আছে। তার মতো মানুষের পাশে বসে দু-একটা ভালো কথা যে মানুষ বলে, তারা তো দেবতার সমান! মতি মিয়াকে রবিনের দেবতা বলেই মনে হয়! দেবতা না হলে কেউ তার মতো একটা নোংরা ছেলের সঙ্গে এতটা অন্তরঙ্গ হতে পারে!

রবিন সারা দিন বোতল কুড়ায়। একসময় সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। দুপুরের দিকে এক জায়গায় বসে সামান্য বিশ্রামও নিয়ে নেয়। তারপর কিছু খেয়েও নেয়। এখন পকেটটা পুরোপুরি শূন্য। রবিন আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে অপলক। তারপর আবার কাজে নেমে পড়ে।

সন্ধ্যানাগাদ বোতল কুড়িয়ে মহাজনের কাছে গিয়ে বিক্রি করে। তার শরীর আর চলতে চায় না। ছোট মানুষ, সারা দিন এভাবে পরিশ্রম করলে শরীর চলবে কীভাবে!

ক্লান্ত পায়ে রবিন তার আস্তানার দিকে হেঁটে চলে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। ঝকঝকে জোছনায় ভেসে যাচ্ছে সারা শহর। রবিন অবাক হয়ে শহরের বড় বড় বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। শহরের ধনী মানুষগুলোর বসবাস এখানে। রবিন স্বপ্ন দেখতেও সাহস পায় না এখানে থাকার। ফুটপাতে কোনো মতে দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই সে মহাখুশি।

ফুটপাতের যে জায়গাটিতে ওরা কয়েকজন ছেলে থাকে, সেখানে গিয়ে রবিন দেখতে পায়, কিছুই আর আগের মতো নেই। সেখানে কাউকে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি লোকজন এসে সবাইকে তুলে দিয়েছে। কয়েকজন ছেলে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক হাতে-পায়ে ধরছে; যদি এতে তাদের মন গলে যায়! তাহলে হয়তো থাকার ব্যবস্থা হয়েও যেতে পারে। কিন্তু কোনো লাভই হলো না। সরকারি লোকজন সবাইকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে।

কোট-টাই পরা একজন ব্যক্তির দিকে রবিন এগিয়ে যায়। বড় কোনো অফিসারই হবে হয়তো। তার কাছে গিয়ে বললে যদি মন একটু নরম হয়!

‘কি রে ছোকরা তোদের বলেছি না এখান থেকে সরে যেতে! কথা কানে যায় না? পিটুনি খাবার খুব শখ হয়েছে বুঝি?’

রবিনকে এগিয়ে আসতে দেখে ক্ষেপে যান অফিসার।

‘স্যার, দয়া করুন আমাদের ওপর। এখান থেকে তাড়িয়ে দিলে এই শহরে আর কোথাও গিয়ে ঠাঁই পাব না।’

রবিন পা জড়িয়ে ধরতে যায় অফিসারের। তিনি লাথি মেরে সরিয়ে দেন রবিনকে। সে দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে।

‘দূর হয়ে যা এখান থেকে। তোদের নোংরামি করার জন্য ফুটপাত বানানো হয়নি।’

কটকমে চোখে অফিসার বলে।

রবিনের মনে হয়, এই অফিসারের চেয়ে মতি মিয়া হাজার গুণে ভালো। শিক্ষিত হলেই কেউ ভালো মানুষ হয়ে যায় না।

বহু দিন হলো রবিন এখানে আছে। বলা যায়, এক প্রকার শান্তিতেই আছে। রাস্তার একটা ছেলে ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকবে, কেউ এসে তাকে বিরক্ত করবে না, এরচেয়ে শান্তি আর কী হতে পারে! কিন্তু রবিন কিছুতেই ভেবে পায় না হঠাৎ করে কেন এই জায়গাটি হতে সবাইকে তুলে দিচ্ছে। এতে তো কারো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। বরং সমাজের কয়েকটা সুবিধাবঞ্চিত মানুষ রাত কাটাতে পারছে। সমাজের উপরতলার মানুষের মেজাজ-মর্জি বোঝা বড় মুশকিলÑ মনে মনে ভাবে রবিন।

তার এখন একটাই চিন্তা, নতুন করে আবার মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। রবিনের পা চলতে চায় না। সারা দিন হেঁটে আসার পর এখন প্রয়োজন ছিল বিশ্রামের। সেটা সম্ভব নয়। নতুন জায়গা খুঁজে না পেলে সে থাকবে কোথায়!

‘এই রবিন, শোন।’

পেছনে কারো ডাক শুনে থমকে দাঁড়ায় সে। চেয়ে দেখে মতি মিয়া তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকছে। রবিন এগিয়ে যায়।

‘কতক্ষণ ধরে তোকে ডাকছি... হুঁশ নেই কোনো?’

রবিন মনে মনে লজ্জিত হয়। আসলে একটা আশ্রয়ের চিন্তায় সে এতটা বিভোর হয়ে ছিল যে, দুনিয়ার কোনো কিছুর প্রতিই তার খেয়াল নেই।

মতি মিয়া প্রশ্ন করে, ‘তা এখন চললি কোথায়?’

রবিনের মুখটা দুঃখে ভারী হয়ে ওঠে।

‘‘থাকার জন্য নতুন জায়গা খুঁজতে হবে।’

‘কিন্তু এই শহরে তোর মতো মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করা সহজ কাজ নয়।’

‘দেখি চেষ্টা করে... ’

রবিন আবার সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

মতি মিয়া তাকে ডেকে ফেরায়।

‘এখন থেকে তুই আমার কাছে থাকবি। আমার সঙ্গে কাজ করবি আর থাকবি। পারবি না?’

খুশিতে রবিনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তার কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। তার ভাগ্য তো এত ভালো হওয়ার কথা নয়!

মতি মিয়া বলতে থাকে, ‘আসলে প্রথম যেদিন আমি তোকে প্রথম দেখি আমার নিজের সন্তানের কথা মনে পড়ে যায়। আমার একটা ছেলে ছিল জানিস? বেঁচে থাকলে এত দিন হয়তো তোর বয়সী হতো!’

মতি মিয়ার চোখের পাতা ভিজে ওঠে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে রবিনের তার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। যদিও সে কখনো তার বাবার চেহারা কেমন তা দেখতে পায়নি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close