আবদুস সালাম

  ০৫ জানুয়ারি, ২০১৯

অত্যাচারী রাজার পরিণতি

বড় একটা বনের পাশে একটা রাজ্য ছিল। রাজ্যটি ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। প্রজারা ছিল সচ্ছল। কিন্তু রাজ্যের রাজা ছিল ভীষণ অত্যাচারী। কেউ কোনো অপরাধ করলে তাকে ভয়নক শাস্তি দিতে কুণ্ঠাবোধ করত না। রাজা কখনো ক্ষমা করত না। চুরি-ডাকাতির অভিযোগ প্রমাণ হলে রাজা তাদের মৃত্যুদ- দিত। কারোর ভুলের কারণে সামান্য ক্ষতি হলে তাকে অধিকহারে জরিমানা দিতে হতো। রাজা লঘু অপরাধে গুরুদন্ড দিত। যখন তখন প্রজাদের জেলখানায় আটকিয়ে রাখত। আর অপরাধ গুরুতর হলে তো কথাই নেই। তাকে শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদন্ড দিত। রাজকর্মচারী ও মন্ত্রীদেরও কোনোভাবে ছাড় দিত না। শাস্তি হিসেবে রাজা প্রায়ই প্রজাদের বনবাসে পাঠাত। শুধু তা-ই নয়, রাজ্যের চাষিরা স্বাধীনভাবে কৃষিকাজ করতে পারত না। চাষিরা কী কী ফসল আবাদ করবে তাও রাজা ঠিক করে দিত। এর ব্যত্যয় হলে রাজার লোকজন ফসল কেটে ফেলত। যুবক ছেলেদের রাজা বাধ্য করত যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। রাজা যাকে পছন্দ হতো তাকে বিয়ে করত। কোনো বাবা-মা রাজার সঙ্গে তার মেয়েকে বিয়ে দিতে অস্বীকার করলে রাজা তাকে বন্দি করে শাস্তি দিত। এভাবে দিন দিন রাজার অত্যাচার বাড়তেই থাকে।

একদা রাজা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার সুচিকিৎসার জন্য রাজপ্রাসাদে একজন বিজ্ঞ হেকিমকে আনা হলো। রাজাকে সুস্থ করার জন্য হেকিম আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু রাজার সুস্থ হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। এতে রাজা হেকিমের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। তার বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে রাজা তাকে কারাদ- দেয়। এই খবরটি সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। রাজ্যের হেকিম, কবিরাজ ও ডাক্তাররা এতে ক্ষুব্ধ হয় কিন্তু তাদের কিছুই করার ছিল না। এই ঘটনার কিছুদিন পর রাজপ্রাসাদে আরেকটি ঘটনা ঘটল। একজন মন্ত্রীর শাসনকার্যে ভুল ধরে রাজা তাকে শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে। ফলে মন্ত্রীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। রাজা কখন যে কার ভুল ধরবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। এসব ভেবে সকলে ছিল দিশাহারা। অথচ রাজার কাজে কেউ ভুল ধরতে পারত না। সবাইকে তার কাজের প্রশংসা করতে হতো। রাজার অত্যাচারে রাজ্যের সবাই অতিষ্ঠ ছিল। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা উপায় খুঁজতে থাকে।

রাজা হঠাৎ আরেক দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাজার আদেশ পেয়ে এক বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী রাজ্যের বিজ্ঞ হেকিম ও কবিরাজদের খোঁজার জন্য বেরিয়ে পড়ে। তারা রাজার চিকিৎসা করতে অপারগতা প্রকাশ করতে থাকে। কেউই রাজার চিকিৎসা করতে রাজি হয় না। এর ফলে ওই রাজকর্মচারী খুব ঘাবড়িয়ে গেল। অবশেষে একজন কবিরাজ রাজার চিকিৎসা করতে রাজি হলো। সেই কবিরাজ ছিল খুবই ধূর্ত। সে কোনো কিছুতেই ভয় পেত না। রাজাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এটাই উপযুক্ত সুযোগ বলে সে মনে করল। কবিরাজকে রাজপ্রাসাদে আনা হলো। সে রাজাকে ভালোভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করল। তারপর রাজাকে বলল, ‘আপনার অসুখটা বেশ গুরুতর। ওষুধে আপনি সাময়িকভাবে সুস্থ থাকবেন। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হবেন না। যেকোনো সময় আপনার মৃত্যু হতে পারে।’ এ কথা শুনে রাজা খুব ভয় পেল। রাজা তার কাছে জানতে চাইল, ‘তাহলে বাঁচার উপায়?’ উত্তরে হেকিম বলল, ‘হ্যাঁ, বলছি। একজন ভালো শাসক হিসেবে রাজ্যে আপনার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। আমরা চাই আপনি দীর্ঘজীবী হন। রাজ্যের পাশে যে বন আছে সেই বনের মাঝে একটি ছোট্ট পরিত্যক্ত ঘর রয়েছে। সেই ঘরের মেঝের ওপর একটি কাঁসার হাঁড়ি বসানো আছে। সেই হাঁড়িতে রয়েছে অমৃত, যা পান করলে আপনি চিরদিনের মতো সুস্থ হয়ে যাবেন। আর আপনি দীর্ঘ জীবন লাভ করবেন। তবে সাবধান! এই কথা আপনি কাউকে প্রকাশ করতে পারবেন না। এই কথা প্রকাশ করলে বা কাউকে দিয়ে তা আনানোর চেষ্টা করলে অমৃতের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। কাজটি যত দ্রুত সম্পন্ন করবেন আপনার জন্য ততই মঙ্গল হবে।’ রাজাকে সুস্থ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে কবিরাজ রাজপ্রাসাদ থেকে বিদায় নিল।

রাজা সারা দিন কবিরাজের কথা চিন্তা করল। সে মনে মনে ভাবলÑ একবার যদি অমৃত পান করতে পারি তাহলে আমি দীর্ঘ জীবন লাভ করব। তাই দেরি করা মোটেও ঠিক হবে না। আজ রাতেই অমৃতের সন্ধানে বের হতে হবে। রাজা কবিরাজের কথামতো বিষয়টি কারোর কাছে প্রকাশ করল না। বনের মধ্যে প্রবেশ করার জন্য নিজেকে তৈরি করল। রাত যখন গভীর হলো, তখন তার এক বিশ্বস্ত কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে প্রাসাদ থেকে বের হলো। গভীর রাতে রাজা কোথায় যাচ্ছেন এ বিষয়ে ওই কর্মচারী জানতে চাইলে রাজা তাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘আর একটিও প্রশ্ন করবে না। আমি যা বলি তাই করো। তুমি এসো আমার সঙ্গে।’ তারপর দুজনে একটি ঘোড়ায় চড়ে বনের নিকটে গিয়ে উপস্থিত হলো। রাজকর্মচারীকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড় করিয়ে রাজা বনের মধ্যে প্রবেশ করল। আর যাওয়ার আগে সে কর্মচারীকে বলল, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি ঘোড়াটি নিয়ে অপেক্ষা করবে।’

বনটি ছিল শ্বাপদসংকুল। দিনেরবেলায় কোনো মানুষ যেতে সাহস পেত না। অথচ রাজা দীর্ঘ জীবন লাভের আশায় কবিরাজের দীক্ষা গ্রহণ করে অমৃতের সন্ধানে বনের মধ্যে সাহসের সঙ্গে প্রবেশ করল। বনের গভীরে প্রবেশ করা তো দূরের কথা। কিছুদূর যেতে না যেতেই রাজা একটা হিংস্র জন্তুর আক্রমণের শিকার হলো। পশুটির আক্রমণে রাজার প্রাণ গেল। ওদিকে সকালবেলায় রাজপ্রাসাদে অসুস্থ রাজাকে দেখতে না পেয়ে রাজার লোকজন তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল। খুঁজতে খুঁজতে তারা ঘোড়াসহ সেই রাজকর্মচারীকে বনের নিকটে পেয়ে গেল। রাজকর্মচারী তাদের গতরাতের ঘটনা হুবহু বর্ণনা করল। তারা কেউই বুঝতে পারল না এর কারণ কী। কেউ কেউ ভাবলÑ রাজা বোধহয় পাগল হয়ে গেছে। রাজার লোকজন রাজাকে খুঁজতে বনের মধ্যে প্রবেশ করল। কিছুদূর যেতেই তারা রাজাকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। রাজার সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। সারা শরীর রক্তেমাখা। রাজার করুণ মৃত্যুর সংবাদ দ্রুত রাজ্যের সকল স্থানে পৌঁছে গেল। অত্যাচারী রাজার মৃত্যুর সংবাদে রাজ্যের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close