আজম সিদ্দিক রুমি

  ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮

কেরামত মাস্টারের ছেলে

বিজয়নগর উচ্চ বিদ্যালয় সাহালের অজানা কিছুই নেই। কারণ এখানে তার বাসা। সে তার মামার জন্য ভিনদেশে পড়াশোনা করত। সাহাল পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। গেল কিছুদিন আগে সমাপনী পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কতই না তার মনে আনন্দ। বোঝাতে পারবে না। পরীক্ষা শেষ খুব খুশি। সাহালের মামারও যাওয়ার সময় আর হলো না কি? সাহালের মামা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনার জন্য পাড়ি দেবে। ভাওয়াল গড়ে সাহালের আর থাকা হবে না। মনটা খুব খারাপ। বন্ধুবান্ধব সবাইকে ছেড়ে ভাওয়াল গড় ত্যাগ করা সাহালের জন্য কষ্টকর। বিধিবাম কিচ্ছুটি করার থাকে না। সাহালের আর ভাওয়াল গড়ে থেকে পড়াশোনা করা হবে না। সাহালকে বিজনগর তার গ্রামের বাসায় পাঠিয়ে দিল। রেজাল্ট হলো। ভালো রেজাল্ট করেছো। সব বিষয়ে অ+ পেয়েছে একটি বিষয় বাদে, সেটা হচ্ছে ইংরেজিতে। সহাল ইংরেজিতে একটু নয় ভালোই কাঁচা। তবু পরিবারে সবাই মহাখুশি। যারপরনাই! সাহালকে ভালো একটি স্কুলে ভর্তি করাবে। কিন্তু বাইরে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার বাবা কেরামত মাস্টার। ছেলেকে খুব কাছাকাছি রাখবে। প্রায় তিন বছর থেকে পৃথক। দূরে পড়াশোনা করে। এখন আর দূরে নয়। আমাদের বাড়ির পাশে বিজয়নগর উচ্চ বিদ্যালয় আছে। এখানে ভর্তি করে দিলে খুব একটা মন্দ হবে না। দেখাশোনা ভালো হবে। ছেলেকে দূরেÑ একা একা রাখলে ছেলেটা আমার থেকে আরো দূরে চলে যাবে। গভীর দূরত্ব তৈরি হবে। সে জন্য আমি কোনো আশার দিক না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত। বরং এখানে পড়বে সব সময় চোখে চোখে থাকবে। পিতা-মাতার শাসন হলো একজন ছাত্রের প্রাথমিক ভূষণ। জীবনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সাহাল বাইরে থাকলে সেটা আর হয়ে উঠবে না। তারপর না হয় চলে যাবে। কেরামত মাস্টারের বড় ইচ্ছে তার ছেলে সরকারি একজন ডাক্তার হবে। মানুষের সেবায় তার প্রতিটি রক্তবিন্দু নিয়োজিত থাকবে। কতই না ভালো হবে। আর আমি সেটাই করব। কেরামত মাস্টার অন্য একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। অনেক ভালো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ছেলেমেয়েকে খুব আদর করেন। একদমই মারধর করেন না। ব্যবহার আচার-আচরণে মিষ্টভাষায় সব ছাত্রছাত্রীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।

ছাত্রছাত্রীরাও জানে কোন বিষয়ের আবেদন করলে একজনই পারবে তাদের আবেদন অধ্যক্ষর নিকট মুঞ্জর করাতে। অন্য কোনো শিক্ষকের কাছে না গিয়ে সোজা কেরামত মাস্টারের কাছে সবার শুভগমন হয়। যদিও কেরামত মাস্টার ইদানীং একটু বিজি সময় পার করে। ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের দায়- দায়িত্ব পালন করছেন।

সাহাল নতুন স্কুলে ভর্তি হলো। নিজের এলাকা অথচ সাহালের কেন যে এখানে ভালো লাগছে না? অনেক বন্ধু-বান্ধবের শোকে মন মরা হয়ে একা একা থাকে। প্রায় এক মাস কেটে গেলে এখনো মনে পড়ে তাদের। সাহালও খুব ভালো ছেলে। গুরুগম্ভীর যাকে বলে। এখানেও তার অনেক বন্ধু-বান্ধব হয়ে গেল। এখন ভালোই চলছে সাহালের পড়ালেখা। সাহালের স্কুলে আজ একটি তালিকা তৈরি করেছেন মিঠু স্যার। যারা গরিব, অসহায়, নিম্নবিত্তরা স্কুল ড্রেস বানাতে পারে না। তাদের একটি করে স্কুল ড্রেস দেওয়া হবে। মিঠু স্যার জানত না তার বাবাও শিক্ষকতা করে। তাদের পরিবার সচ্ছল। দশজনের মাঝে সাহালেরও নাম লিখেছেন। আর বাবার নাম লিখেছে কেরামত কষাই। বিজয়নগরে কেরামত কষাইও আছে। মিঠু স্যার কেরামত মাস্টারকে চিনেন না। সাহাল তার বাবার নাম ভিন্ন দেখেও চুপ করে বসে থাকল, কিচ্ছু বলল না। পরদিন দশজনকে স্কুল ড্রেস দিয়ে দিল। সাহালও একটি পেল, সাহাল ভালোই খুশি হলো। সাহাল লেখাপড়ায় ভালো। নিয়মিত সাহালের খোঁজখবর নিতে লাগল। মিঠু স্যার থেকে শুরু করে স্কুলের প্রিন্সিপাল পর্যন্ত। তাকে সবাই চিনত। প্রায় এক মাস পার হয়ে গেল। সব স্যারের ভালো ফোকাসিং হয়ে উঠল। মিঠু স্যার প্রায় বলে, কেরামত কষাইয়ের ছেলে এসেছে কি? সে ভালো পড়ালেখা করে। তার একসময় কেরামত কষাই, কেরামত কষাই, ‘কষাই নামটি পীড়াদায়ক মনে হতে লাগল। সাহালের বাবা মাস্টার। কেন তাহলে কষাই বলবে? এই ভেবে ভেবে আজ সারারাত সাহালের নেই দুচোখে ঘুম। একা একা বেদনা অনুভব করে। আর মনে মনে, মনের সাথে কথা বলে। আমি যদি সেদিন নামটি সংশোধন করে দিতাম, তাহলে আজ কেরামত কষাই এই ডাকটির পীড়া আর পোহাতে হতো না। এখন কী উপায়? স্যারকে কি তবে সবকিছু খুলে বলব?

সাহাল স্কুল যায় কিন্তু লজ্জায় মুখ লাল করে ফেলে। কারো সাথে তেমন কথা বলে না চুপচাপ থাকে। বেশ ফলো করছে সাহাল ইদানীং একা একা থাকে কেন? কারো সঙ্গে কোনো কথা বলে না। আগের মতো আর আমাদের সাথে মিশে না। কী হলো ওর? সবার একই প্রশ্ন নেই কোনো উত্তর। একা একা স্কুল আসে আর ছুটির ঘন্টা পড়লে দ্রুত বাসায় চলে যায়। কেন? বন্ধুরাও চেয়ে আছে শোনার জন্য উৎসুক রাফি। রাফি তার খুব কাছের বন্ধু জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সাহাল সিদ্ধান্ত নিল আজকে মিঠু স্যারকে সব বলে দেবে। আমরা সচ্ছল পরিবার। আমার বাবা মাস্টার। আমি আর এই পীড়া নিতে পারছি না। সত্যি সত্যি সাহাল স্যারের রুমে চলে গেল। অনেক শিক্ষক থাকার কারণে সে কিছুই বলতে পারল না। চুপ করে পিছু হটে গেলে। খেয়াল করে মিঠু স্যার কখন একা হয়! ছোট মনে যা আসছে সাহাল তাই করছে। আজাদ স্যারের ক্লাস পরে, অফিসে চোখ বুলাতেÑ দেখল মিঠু স্যার একা। ঠিক তখনই দৌড়ে অফিস রুমে গেল ব্যাগ কাঁধে করে। মিঠু স্যার, কী হয়েছে সাহাল? তুমি কেরামত কষাইয়ের ছেলে না। জি স্যার। সাহালের হৃদয় মনে হচ্ছে ভেঙে ভেঙে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে। মিঠু স্যারকে সাহাল সবকিছু খুলে বলল। সাহাল এই পীড়া থেকে একটু হলেও উদ্ধার হলো। মিঠু স্যার সাহালকে বুকে জড়িয়ে নতুন প্রণয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করলেন।

তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছো। এ জন্য আমি গর্ববোধ করছি। সাহালকে তার মতো ও সততার জন্য মিঠু স্যার পুরস্কৃত করলেন। সেই স্কুল ড্রেসটি ফেরত না নিয়ে তাকে দিয়ে দিলেন। সাথে আরো কিছু বই উপহারস্বরূপ দিলেন। সাহাল এখন কেরামত মাস্টারের ছেলে!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close