রুনা তাসমিনা

  ০১ ডিসেম্বর, ২০১৮

বুড়োগাছের ছোট বন্ধু

সুজনকে কাছাকাছি আসতে দেখেই গাছবন্ধু হেসে জিজ্ঞেস করল, স্কুল ছুটি? হ্যাঁ। বলে ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে সুজন বসে পড়ল গাছটির কোমর থেকে বেরিয়ে পড়া একটি গুঁড়ির ওপর। কি ব্যাপার বলত ছোট্ট বন্ধু? মন কেন খারাপ? হবে না? মাকে বললাম আজ ভাপা পিঠা বানাতে, স্কুল থেকে ফিরে খাব। কিন্তু মা ভুলেই গেছে। সুজনের কথা শুনে হো হো করে গা ঝাঁকিয়ে হেসে উঠল গাছবন্ধু। সঙ্গে সঙ্গে টুপটাপ করে কত আম ঝরে পড়ল গাছ থেকে। বলল, জ্যৈষ্ঠ মাসে ভাপা পিঠা! হো হো। এই নাও আমগুলো। খেতে খেতে রাগ থামাও। আর আঁটিগুলো যত্ম করে রেখে দিও। তাইতো! এবার সুজনের মনে পড়ল শীত পড়লে তবেই তো ঘরের পাশে মাটির চুলো বানিয়ে সেই চুলোতে ভাপা পিঠা বানায়। আর সুজন মায়ের পাশে বসে চাদর মুড়ি দিয়ে গরম গরম পিঠা খায়। লজ্জা পেয়ে সুজন বলল, আমি কি তোমার মতো ঋতু চিনি? যখন তোমার মতো অনেক বড় হব তখনই তো চিনব। এভাবে হেসো না বন্ধু! সুজনের লজ্জা পাওয়া যেন বুঝতে পেরে গাছবন্ধু হাসি থামিয়ে বলল, আচ্ছা আর বলব না। এবার বল স্কুলে আজ কি কি পড়লে? বাংলা, গণিত, ইংরেজি। জানো আজ বাংলা স্যার ‘বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য’ রচনা পড়ানোর সময় তোমাদের খুব তারিফ করেছেন। গাছবন্ধু খুব উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইল, কি বললেন! বললেন, এই দেশ সবুজ দেশ বলে গাছের জন্য। মানুষের যেমন প্রাণ আছে, গাছেরও তেমনি প্রাণ আছে। গাছ না থাকলে আমরা বাঁচতে পারতাম না। তোমরা যে নিঃশ্বাস নাও সে কার্বন-ডাই-অক্সাইডও গাছই দেয়। গাছ না থাকলে বৃষ্টি হতো না। এ রকম বিভিন্নভাবে গাছ আমাদের অনেক উপকার করে। খুশির স্বরে গাছবন্ধু বলল, তাই? হ্যাঁ। জানো স্যার, যখন তোমাদের তারিফ করছিলেন আমার খুব খুশি লাগছিল!

চোখ দুইটিতে খুশির ঝিলিক সুজনের। আমের আঁটিটি চুষতে চুষতে কি যেন ভাবছে সে। একটু পরই বলল, আচ্ছা গাছবন্ধু, তোমার বয়স কত? তুমি কি মায়ের সমান হবে? বাবা হারা এই ছেলেটির সবকিছু মাকে ঘিরেই। সবুজ গ্রামটির একপাশে নদী। ঘরগুলো কোনোটা বেড়ার আবার কোনোটা মাটির তৈরি। দলবেঁধে ছেলেমেয়েরা সব গ্রামের বিদ্যালয়ে পড়তে যায়। বিকেল বেলা স্কুল থেকে ফিরে বন্ধুরা যখন নদীর পাড়ে, স্কুলের মাঠে খেলতে যায়, সুজন তখন চলে আসে বিশাল এই আমগাছের কাছে। ওদের বন্ধুত্ব হওয়ার ঘটনাও বেশ মজার। বেশ কিছু দিন আগে মা সুজনকে পাঠিয়েছেন কিছু শুকনো কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে যেতে। বনের এখানে সেখানে পড়ে থাকা কাঠগুলো কুড়িয়ে আমগাছটির গোড়ায় জমা করল। বাড়ি ফেরার সময় বাধলো বিপত্তি। এত কাঠ একসঙ্গে নিয়ে বাড়িতে যাওয়া সম্ভব না। কি করবে বুঝতে পারছে না। এমন সময় গাছটি। হঠাৎ কথা বলে উঠল, এত চিন্তা কিসের ছোট্ট বন্ধু? এখন কিছু নিয়ে বাড়ি যাও বাকিগুলো পরে এসে নিয়ে যেও, কেমন! সুজন ভয় পেয়ে গেল। শুনছে বনে নাকি জ্বিনরা থাকে। জ্বিনের খপ্পরে পড়ল না তো!

বুঝতে পেরে গাছ বলল, কেন ভয় পাচ্ছ বন্ধু? তুমি লক্ষ্মী ছেলে। মাকে সব কাজে সহযোগিতা কর। আর যারা লক্ষ্মী আমি তাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করি। সুজন আশ্চর্য হয়ে গাছের কথা শুনল। মনে মনে ভাবছে কোনো মতে এখান থেকে পালাতে পারলে হবে। আর কখনো এ মুখো হবে না। কিন্তু পর দিন অদৃশ্য একটি টান তাকে বিকেল বেলা আবার নিয়ে গেল সেই গাছের কাছে। ভেবেছিলে আসবে না। তাই না? হাসি হাসি স্বরে গাছ বলল। কি অবাক কান্ড! তুমি তো মনের কথাও বলে দিতে পার! কেন বুঝব না! আমি হচ্ছি এ বনের সবচেয়ে বুড়ো গাছ। এই যে বনে অনেক গাছ দেখছ? এরা সবাই আমার সামনে বড় হয়েছে। গাছ হো হো করে হেসে উঠল সুজনের কথায়। পাতা ঝিরিঝিরিয়ে বাতাস দিয়ে বলল, আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম।

সেই থেকে সুজনের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব। বিকেল বেলা স্কুল থেকে ফিরেই চলে আসে গাছের কাছে গল্প শুনতে। কত গল্প জমা আছে গাছের বুকে! এখন আর সুজনকে কাঠের জন্যে সারা বন ঘুরে বেড়াতে হয় না। গাছবন্ধুটি তার শুকনো ডালপালাগুলো ফেলে দেয় সুজনের জন্য। গরমে যখন অস্থির লাগে পাতাগুলো দুলিয়ে দুলিয়ে বাতাস করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আমের মৌসুমে মিষ্টি পাকা আম খেতে দেয়। খুব ভালোই কাটছিল দুই বন্ধুর দিন। হঠাৎ একরাতে প্রচন্ড ঝড় এলো। সুজনদের বেড়ার ঘরটি ভেঙে গেল। পর দিন সকালে কাঁদতে কাঁদতে সুজন গাছবন্ধুর কাছে এলো। দেখল ঝড়ে তার গাছবন্ধুর সব ডালপালা ভেঙে গেছে। গাছবন্ধু উপড়ে পড়েছে মাটির ওপর। দেখে সুজনের কান্না আরো বেড়ে গেল। সুজনকে দেখে বলল, আমি আর বাঁচব না ছোট্টবন্ধু। আমার ডালপালাগুলো নিয়ে তোমাদের ঘরটি নতুন করে তৈরি করে নাও। কথাগুলো বলেই গাছবন্ধুটি হাঁপিয়ে উঠল। একটু থেমে আবার বলল, তোমার কাছে আঁটিগুলো জমা আছে না? ওগুলো আমার চারপাশে পুঁতে দিও। আমি আবার তোমার মতো ছোট থেকে বড় হব। সুজন কাঁদতে কাঁদতে বলল, সব ঠিক আছে। কিন্তু আমি তোমাকে চাই। গাছবন্ধু কষ্টের হাসি হেসে বলল, আমি তো থাকব। তোমার সঙ্গেই থাকব। এত দিন তো শুধু স্কুল ছুটির পর তুমি আমার কাছে আসতে। যখন আমাকে দিয়ে যখন তুমি নতুন ঘর তৈরি করবে তখন সারা দিন রাত আমি তোমার কাছেই থাকব। রাতে মা যখন ঘুমিয়ে পড়বে আমি আর তুমি চুপিচুপি কথা বলব। বলেই গাছবন্ধু চুপ হয়ে গেল। সুজন ডাকে, গাছবন্ধু! ও গাছবন্ধু! ওদিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। পার হয়ে গেল বেশ কয়েক মাস। সুজন গাছবন্ধুর কথা রেখে, জমিয়ে রাখা আমের আঁটিগুলো গাছবন্ধু যেখানে ছিল তার আশপাশে লাগিয়ে দিয়েছিল। ওরা বড় হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। প্রতিদিন বিকেল বেলা সুজন গিয়ে ওদের দেখে আসে। হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়। সুজনদের নতুন ঘরের খুঁটি গাছবন্ধুর কাঠ দিয়ে তৈরি। রাতে মা যখন ঘুমিয়ে পড়ে সুজন ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তলিয়ে যায় ঘুমের দেশে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close