আরাফাত শাহীন

  ২৪ নভেম্বর, ২০১৮

অভাব

কনকনে শীতের রাত। শীতের দাপটে শরীর অবশ হওয়ার দশা। এমন শীতে বিশেষ প্রয়োজন না হলে কেউ ঘর থেকে বের হতে চায় না। খামোখা এমন কঠিন শীতে কে কষ্ট পেতে চায়! মাসুদ পড়ার ঘরে কুপি জ্বালিয়ে পড়ছে। ওদের এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ চালু হলেও সে সুবিধাটা ওরা এখনো পায়নি। মাসুদ পড়ছে আর বারবার দুই হাত পরস্পর ঘসছে। ঠান্ডায় শরীর গরম করার চেষ্টা। কিন্তু এতে আর কতটুকুই বা গরম হয় শরীর! গায়ে যদি শীতের পোশাক না থাকে, তাহলে এমন শীতে কষ্ট ভোগ করা ছাড়া উপায় নেই।

মায়ের লক্ষ্মী ছেলে মাসুদ। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করে। আবার বাড়িতে মায়ের সমস্ত কাজে সাহায্যও করে। পারতপক্ষে মাকে ও তেমন কোনো কাজই করতে দেয় না। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘরদোর পরিষ্কার করাÑসমস্ত কাজই ও করতে পারে। শুধু কী তাই! বাবা মারা যাওয়ার পর পুরো সংসারটাকেই তো ও চালিয়ে নিচ্ছে। বাড়ির অদূরেই রাস্তার মোড়ে মাসুদের চায়ের দোকান। নাম মাসুদের চা-ঘর। সুন্দর করে হাতে লেখে একটা সাইনবোর্ডও দোকানে টাঙিয়ে দিয়েছে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির সমস্ত কাজ গুছিয়ে স্কুলে চলে যায় মাসুদ। তারপর ছুটি হলে সোজা বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে দোকানে গিয়ে বসে। বেশ রাত অব্দি দোকানে বসে থাকতে হয়। দোকান থেকে ফিরে এসে স্কুলের পড়া রেডি করা। এর মাঝে আবার মায়ের দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। একমাত্র মা ছাড়া দুনিয়াতে মাসুদের আর কেউ নেই। ও যদি মায়ের দিকে খেয়াল না রাখে, তাহলে আর কে রাখবে!

মায়ের শরীরটা আজ কদিন ধরে বেশ খারাপ যাচ্ছে। তিনি অবশ্য তেমন কিছু ওকে বলেন না। তবে মাসুদ সবই বুঝতে পারে। মাসুদ জানে, মা সহজে কিছু বলবেন না। তাই ও নিজে থেকে মায়ের চিকিৎসার কথা ভাবতে থাকে। গোপনে বেশ কিছু টাকা জমা করেছে। তা দিয়ে মায়ের চিকিৎসা করাতে হবে। মাসুদ দোকানে যাওয়ার সময় মা কাছে ডেকে বললেন, ‘বাবা, আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে আসিস। আমার একা একা কেমন কেমন লাগে।’

‘ঠিক আছে মা। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। আমি দ্রুত চলে আসব।

মাসুদ দোকানের দিকে পা বাড়ায়।

দোকানে এসে মাসুদের মন টিকতে চায় না। মায়ের কথাটা আজ বেশি বেশি মনে পড়ছে। সময়ের চেয়ে দ্রুত ফিরে আসতে হয়। ঘরে ফিরে দেখে মা লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। মাসুদ মায়ের কাছে এগিয়ে যায়। রাহেলা বেগম ছেলেকে মাথার পাশে বসান।

‘শরীরটা বেশি ভালো লাগছে না বাবা। বুকের ভেতর কেমন ধড়ফড় করছে।

‘তারিক ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসব?

‘না বাবা। তার দরকার নেই। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি গিয়ে পড়তে বসো।

মায়ের কাছ থেকে উঠে এসে পড়তে বসে মাসুদ। আগামীকাল ইংরেজি পরীক্ষা। না পড়ে তার কোনো উপায় নেই।

মাসুদ গা দুলিয়ে পড়ছে আর মায়ের দিকে নজর রাখছে। ওর পড়ার রুম আর মায়ের রুম পাশাপাশি লাগোয়া। দুই রুমের মাঝখানে একটা দরজা। মাসুদ রুমে ঢোকার সময় দরজা খুলে রেখে এসেছিল। ফলে মায়ের দিকে খেয়াল রাখতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। মাসুদ গভীরভাবে পড়ায় নিবিষ্ট। হঠাৎ মায়ের অস্পষ্ট আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে। মায়ের দিকে ঘুরে তাকায়। মা কেমন যেন করছেন। চেয়ার ছেড়ে দ্রুত মায়ের কাছে এগিয়ে যায় মাসুদ। মায়ের হাত ধরে দেখে হাত বরফের মতো ঠা-া। হাত দুটো তো এতক্ষণ লেপের নিচে ছিল। তাহলে এমন ঠা-া হওয়ার কারণ কী? মাসুদ এবার মায়ের পায়ে হাত রাখে। পা দুটোও বরফশীতল। মাসুদ বুঝতে পারে ওর ডাক্তার ডাকা জরুরি। কিন্তু ও যদি ডাক্তার আনতে যায় তাহলে মায়ের পাশে থাকবে কে? এ মুহূর্তে মায়ের কাছে কারো থাকা প্রয়োজন। বুদ্ধি করে পাশের বাড়ির সবুজকে ডাক্তার আনতে পাঠায়। নিজে বসে থাকে মায়ের কাছে। মা কথা বলতে পারছেন না। তার গলা দিয়ে অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে। চোখে টলমল করছে অশ্রু। মায়ের চোখে পানি দেখে কান্নায় ওর নিজের বুকও ভেঙে আসতে চায়। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে। এই কঠিন মুহূর্তে কিছুতেই ওকে ভেঙে পড়লে চলবে না।

ডাক্তার তারিকুল ইসলাম চমৎকার মানুষ। কারো বিপদে আপদে ডাকতেই সাইকেল চালিয়ে হাজির হয়ে যান। মাসুদ ডেকে পাঠানোর আধা ঘণ্টার মধ্যেই ডাক্তারের সাইকেলের আওয়াজ পাওয়া যায়। মাসুদ মনে মনে স্বস্তি পায়। ডাক্তার এসে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তার মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। মাসুদের চিন্তা বেড়ে যায়। ও ডাক্তারের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার বলেন, এক্ষনি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। তিনি অক্সিজেনের অভাব বোধ করছেন। অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

এত রাতে কীভাবে হাসপাতালে নিয়ে যাবো? মাসুদের গলার স্বর কাঁদকাঁদ।

‘আমি সে ব্যবস্থা করে দেব।

ডাক্তার সাহেব নিজে ভ্যানের ব্যবস্থা করে দিলেন। এমনকি মাসুদ ওদের সাথে হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে বললে তিনি তাতেও রাজি হয়ে গেলেন।

কনকনে শীতের রাত। বাইরে উত্তুরে হাওয়া যেন শরীরে সুচ ফুটিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মাসুদ ওর মাকে নিয়ে ছুটে চলেছে হাসপাতালের দিকে। লেপ দিয়ে মায়ের সারা শরীর আবৃত করা। বাইরে ভয়ানক ঠা-া। মাসুদের শরীর আড়ষ্ট হয়ে আসতে চায়। কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

ওর একমাত্র চিন্তা মাকে নিয়ে। দুনিয়াতে আপন বলতে শুধু মা-ই আছেন। তিনিও আজ মাসুদকে ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছেন! মাসুদের ভীষণ কান্না পায়। চোখ থেকে দুফোঁটা তপ্ত অশ্রু ঝরে পড়ে। হঠাৎ ডাক্তারের ডাকে চমক ভাঙে। মায়ের হাত ধরে বসে আছেন তিনি। আর বিড়বিড় করে পড়ছেন, ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না...।

মাসুদ বুঝতে পারে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করেছেন মা। মাসুদের বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। ওর মনে হয় পৃথিবীতে আজ অক্সিজেনের বুঝি বড় অভাব! ওর মা তো এই অক্সিজেনের অভাবে মারা গেলেন!

ডাক্তার সাহেব, দুনিয়াতে এত অক্সিজেন থাকতে আমার মা অক্সিজেনের অভাবে কেন মারা গেলেন! ডাক্তার সাহেব নির্বিকার বসে রইলেন। তার চোখেও বুঝি দুফোঁটা অশ্রু টলমল করে উঠল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close