মোহাম্মদ অংকন

  ১৭ নভেম্বর, ২০১৮

রুপা ও রুমির গল্প

সেদিন রুপা ও রুমির শ্রেণিতে আসতে বড্ড দেরি হয়ে যায়। স্যার নাম প্রেজেন্ট শেষ করে একটি নোটিস বইতে স্বাক্ষর করছেন। তাড়াহুড়ো করে রুপা ও রুমি দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।

‘স্যার, ভেতরে আসতে পারি কি?’

‘হুম, দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসো। তোমাদের আসতে এত দেরি কেন হলো?’

স্যারের ভয়ে রুমি ও রুপা থরথর করে কাঁপছিল। না জানি কী শাস্তি হয় ওদের!

‘কী হলো? কথা বলছো না কেন তোমরা?’

‘স্যার, নৌকায় পাড় হতে দেরি হয়ে গেছে।’

‘ও আচ্ছা। এটা কোনো ব্যাপার না। তোমরা আমাকে দেখে ভয় পেয়ো না। যাও বেঞ্চে গিয়ে বসো। এখনই তোমাদের একটি নোটিস পড়ে শোনানো হবে।’

সবাইকে এই কথা বলে ইংরেজি শিক্ষক নরেশ চন্দ্র স্যার নোটিসটি পড়ে শোনাতে লাগলেন।

‘এতদ্বারা অত্র বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর অবগতির জন্য বলা হচ্ছে যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজয় ফুল তৈরীকরণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে। এই প্রতিযোগিতাটি বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর সেনানি এবং সাধারণ মানুষের স্মরণে আয়োজন করা হবে। সেই ফুল ধারণ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের তৈরি বিজয় ফুলের কিছু শুভেচ্ছা মূল্যে বিক্রি হবে। বিক্রয়লব্ধ অর্থ ব্যয় করা হবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বা প্রতিবন্ধীদের সহায়তার জন্য। প্রতিযোগিতাটি স্কুল, উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হবে। তাই আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ওই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য বলা হচ্ছে।’

স্যারের নোটিস পড়া শেষ হতেই দফতরি রহমান চাচা নোটিসটা অন্য কক্ষে নিয়ে গেলেন। কিন্তু স্যারের নোটিস এখনো বুঝে উঠতে পারে নাই কেউ। সবাই কানাকানি করতে লাগল। স্যার একটু ধমকের সুরে বললেন, ‘কী হয়েছে তোমাদের? এত কথা বলছো কেন? বই বের করো সবাই।’

কিন্তু ‘বিজয় ফুল’ কী? এ কথাটি সবার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। এ ওকে বলছে তো ও একে বলছে স্যারকে জিজ্ঞেস করতে। কেউ সাহস পাচ্ছে না। ওদিকে স্যার পড়ানো শুরু করে দিয়েছেন। অতঃপর সাহস করে তুষার দাঁড়িয়ে গেল।

‘স্যার, একটা প্রশ্ন করার ছিল?’

‘পড়া শুরু না করতেই প্রশ্ন কিসের?’

‘না স্যার, আপনি একটু আগে নোটিস দিলেন। নোটিসটা বেশ বুঝেছি। কিন্তু ‘বিজয় ফুল’ কী? এটা আমরা কেউ জানি না। যদি একটু বলতেন।’

‘ও আচ্ছা। আমি তো সে ব্যাপারে আলোচনার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। পড়া শুরুর আগে তাহলে ওটা নিয়ে আলোচনা করা যাক।’

সমস্বরে সবাই ‘জি স্যার’ বলে উঠল।

‘বিজয় ফুল হলো আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা। এই ফুলের ছয়টি পাপড়ি ও একটি কলি থাকবে। ফুলের ছয়টি পাপড়ি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে স্মরণ করাবে এবং মাঝখানের কলিটি ৭ মার্চের প্রতীক হবে। রঙিন কাগজ কেটে আঠা লাগিয়ে এ ফুল তৈরি করতে হবে। যাদেরটা সুন্দর হবে, তারা বিজয়ী হবে এবং পুরস্কৃত হবে।’

স্যারের কথা এবার সবাই বুঝতে পারল। ‘জি স্যার, আমরা বুঝতে পেরেছি।’

(২)

স্কুল ছুটি হয় বিকালবেলা। তারপর বাড়িতে খেলাধুলা করার সময় থাকে। সেদিন রুপা ও রুমি কোথাও খেলতে গেল না। তারা স্কুল থেকে ফেরার পথে বাজার থেকে কাগজ, আঠা, পেন্সিল কিনে নিয়ে গিয়েছিল। তাই সেগুলো দিয়ে শাপলা ফুলের মতো করে বিজয় ফুল তৈরি করতে লেগে পড়ল। প্রথম প্রথম তারা পারছিল না। ঠিকঠাক কাগজ কাটতে পারছিল না। কাগজ ছিঁড়ে যাচ্ছিল। তবু ওরা হাল ছাড়েনি। এভাবে ওরা বাড়িতে বিজয় ফুল বানানো শিখতে শুরু করে ফেলল।

সপ্তাহখানেক পর রুপাদের বিদ্যালয়ে বিজয় ফুল তৈরির প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হলো। এতে বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করল। প্রতিযোগিতা শেষে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করলেন।

‘প্রিয় উপস্থিতি, আজকের বিজয় ফুল প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রুপা, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে রুপার বোন রুমি এবং...’

এভাবে স্যার দশজনের নাম ঘোষণা করলেন যারা কি না উপজেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করতে যাবে। সেদিন রুপা ও রুমি বেশ আনন্দিত হলো। তারপর বাড়িতে গিয়ে আরো চমৎকার করে বিজয় ফুল তৈরির চেষ্টা করতে থাকল।

দু-তিন দিন পর উপজেলা পর্যায়ে বিজয় ফুল প্রতিযোগিতার আয়োজন অনুষ্ঠিত হলো। সেখানে রুপারা দশজনই অংশগ্রহণ করল। প্রতিযোগিতা শেষে উপজেলা প্রশাসক বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করলেন।

‘উপজেলা পর্যায়ে আজকের বিজয় ফুল প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে নূরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রুপা এবং...’

রুপা নিজের নামটি মাইকে শুনতে পেয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠল। কিন্তু তার বোন রুমির নাম ও বিদ্যালয়ের অন্যদের নাম শোনা গেল না। রুমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। রুপা তাকে সান্ত¡না দিল।

‘রুমি, প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে কাঁদতে নেই। আমি তো জিততে পেরেছি। তুমি আমাকে সহযোগিতা করো। আমি জেতা মানেই তোমার জেতা।’

রুমি তার বোনকে সার্বক্ষণিক সাহায্য-সহযোগিতা করতে লাগল। রুপাও আত্মবিশ্বাস নিয়ে আরো সুন্দর করে বিজয় ফুল তৈরি করা শিখতে লাগল। তারপর জেলাপর্যায়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু এবার রুপা আর প্রথম স্থান অধিকার করতে পারল না। সে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তার বোন রুমি এবার তাকে সান্ত¡না দিল।

‘আপু, তুমি তো আমার মতো হেরে যাওনি। এবার দ্বিতীয় হয়েছো তো আরেকবার প্রথম হবে। অতঃএব তোমাকে আরো সুন্দর করে বিজয় ফুল তৈরি করা শিখতে হবে।’

রুপা রুমির কথায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল এবং চেষ্টা করতে থাকল।

তারপর বিভাগীয় পর্যায়ে বিজয় ফুল তৈরির প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হলো। ফলাফল ঘোষণায় এবার রুপা তৃতীয় স্থান অধিকার করল। সে প্রচ- কান্নায় ভেঙে পড়ল।

‘আমি কোনো দিনই প্রথম হতে পারব না। তাই আমি আর প্রতিযোগিতায় যাব না।’ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রুপার অসম্মতির কথাটি জানতে পারলেন।

‘দেখ রুপা, আমাদের বিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে তুমিই একমাত্র বিভাগীয় পর্যায়ে জিতে জাতীয় পর্যায়ে লড়াই করার সুযোগ পেয়েছো। এই সুযোগ কোনো মতেই হাতছাড়া করা যাবে না। এবার না হয় তৃতীয় হয়েছে, শেষ পর্বে যদি প্রথম হও? হতাশা নয়, চেষ্টা করতে হবে।’

রুপা স্যারদের কথায় প্রেরণা নিয়ে আবারও বিজয় ফুল তৈরির অনুশীলন করতে লাগল।

তারপর এলো কাক্সিক্ষত দিন। রুপা অজোপাড়াগাঁয়ের একটি বিদ্যালয় থেকে বিজয় ফুল তৈরির প্রতিযোগিতার জন্য রাজধানী ঢাকায় চলে এলো। ঢাকার একটি বিদ্যালয়ের বড় মাঠে প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হলো। রুপা এবার অনেক সুন্দর করে বিজয় ফুল তৈরি করতে পেরেছে। তাই তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। অতঃপর বিকেলে প্রধানমন্ত্রী প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করলেন। মাইকের আওয়াজে প্রথম স্থান অধিকারী হিসেবে রুপার নামটি ভেসে এলো। রুপা ছুটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার তুলে নিল। হাজার হাজার মানুষ তাকে করতালি দিল। সাংবাদিকরা ছবি তুললেন। রুপাকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল। তারপর রুপা পুরস্কার নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেল।

রুপার জাতীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করায় বিদ্যালয়ের সবাই গর্ববোধ করল। প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘তুমি শুধু বিজয় ফুল প্রতিযোগিতায় বিজয়ই হওনি, তুমি আমাদের বিদ্যালয়ের নামটি সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছো। তোমাকে ধন্যবাদ।’ রুপার বিজয়ে তার বোন রুমিও খুব খুশি হলো।

‘আপু, তুমি প্রমাণ করলে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে চেষ্টা করলে বিজয় হওয়া যায়।’ তারপর তারা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে বিজয় উদ্্যাপন করল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close