আবদুস সালাম

  ০৩ নভেম্বর, ২০১৮

হেমন্তের ছুটিতে

এখন অগ্রহায়ণ মাস। কয়েক দিন আগে লামিয়ার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত স্কুল ছুটি থাকবে। দুই সপ্তাহের জন্য সে বাবার সঙ্গে ঢাকা থেকে দাদার বাড়িতে গিয়েছে। তার দাদার বাড়ি মুজিবনগর উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামে। ওদিকে খুলনা থেকে লামিয়ার ছোট চাচা ও চাচাতো বোন নুর্সিয়াও গেছে দাদার বাড়িতে। গোপিনাথপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। এটি কিছুদিন আগেই খনন করা হয়েছে। এবার বর্ষার স্থায়িত্ব বেশি দিন ছিল। তাই নদীর পানি এখন কানায় কানায় পূর্ণ। ছোট ছোট ঢেউয়ের ছন্দে নদটা আপন মনে বয়ে চলেছে। গোপিনাথপুর গ্রামে লামিয়ার সমবয়সী অনেকেই রয়েছে। তাদের সঙ্গেও তার বেশ সখ্য। সবার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন স্কুল ছুটি। পড়াশোনার কোনো চাপ নেই। ছুটির কয়েকটা দিন তারা গ্রামে খুব মজা করে সময় কাটাবে। গোপিনাথপুর গ্রামেই ফুফুদের বাড়ি। ফুফুর মেয়ে রেশমাও লামিয়ার সমবয়সী। সেও প্রতিদিন লামিয়া ও নুর্সিয়াকে সঙ্গ দেয়। রাতেরবেলায় লামিয়া আর নুর্সিয়া একই ঘরে ঘুমায়। ঘুমানোর আগে তারা নানা বিষয় নিয়ে গল্পগুজব করে। গ্রামে তারা আর কী কী করবে, কোথায় কোথায় যাবে সেসব বিষয় নিয়ে একটা পরিকল্পনা করে। চাচাতো ভাই রাকিব বয়সে একটু বড়। সেও মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গ দেয় এবং বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়।

খুব সকালেই লামিয়া, নুর্সিয়া, রাকিব ও রেশমা ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তারা একসঙ্গে হাঁটতে বের হয়। রাতের শিশিরে মেঠোপথ, গাছপালা সব ভিজে যায়। ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু জমে থাকে। সকালবেলায় সুয্যিমামা যখন সোনালি আলো ছড়িয়ে দেয়, তখন শিশির বিন্দুগুলো নানা বর্ণের রং ছড়ায়। সারা মাঠে মনে হয় ঝলমলে মুক্তা ছড়ানো। শিশিরে পা ভেজাতে তাদের খুব ভালো লাগে। খালি পায়ে তারা মাঠের মধ্যে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। তারপর নদের উদ্দেশে আবার হাঁটতে থাকে। নদের তীরে গিয়ে দেখে সাদা সাদা রাজহাঁস সারিবদ্ধ হয়ে নদের বুকে সাঁতার কাটছে। যেন তারা আনন্দভ্রমণে বের হয়েছে। আর কয়েকটি পাতিহাঁস ডাঙাতে গুগলি ঝিনুক খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। নদের দুই পারে অবারিত মাঠ। মাঠে মাঠে সোনারঙের পাকা ধান। চারদিকে নতুন ধানের মিষ্টি গন্ধ। যেদিকে তাকাই দুচোখ জুড়িয়ে যায়। মাথাল মাথায় কৃষকরা সারিবদ্ধভাবে ধান কাটছে। পাকা ধানের খেত আর ধান কাটার দৃশ্য দেখে তাদের মনটা খুশিতে নেচে ওঠে। কুয়াশার চাদরে মোড়া হেমন্তের ফসলের মাঠ যেন এক অনাবিল আনন্দের উৎস। মটরশুঁটি, শিম, লাউ আর পুঁইয়ের খেত মাড়িয়ে তারা ঘুরতে ঘুরতে আবার বাড়িতে ফিরে আসে। বাড়িতে এসে তাদের চোখে পড়ে নতুন ধানের চাল দিয়ে নানা স্বাদের পিঠাপুলি, ক্ষীর, পায়েস দাদি তৈরি করে থালায় সাজিয়ে রাখেন। তারা সেগুলো পেট ভরে খায়। দাদি প্রতিবেশীদের জন্যও কিছু পিঠাপায়েস বিতরণ করেন। সকালবেলায় গাছিরা বাঁকে করে খেজুরের রস বিক্রি করতে বের হয়। শহরে সব সময় খেজুরের টাটকা রস পাওয়া যায় না বলে দাদা প্রতিদিন একভাঁড় করে খেজুরের রস কিনে রাখেন।

দাদাদের জমিতে ধানকাটা শুরু হয়েছে। কৃষকরা নসিমনে করে ধানের শিষের আঁটিগুলো উঠানের একপ্রান্তে জড় করে রাপ্রণ। তারপর সময় করে সেগুলো মেশিনের সাহায্যে মাড়াই করে। দাদা-দাদি খড়-বিচালিগুলো এক জায়গায় পালা দিয়ে রাখে। এতে তারা ক্লান্ত হলেও মুখে অনাবিল হাসির রেখা ফুটে থাকে। লামিয়া ও নুর্সিয়া দুজনই দাদা-দাদিকে সাহায্য করে। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই কুয়াশারা ভিড় করতে শুরু করে। হেমন্তকালে কুয়াশার এই মনজুড়ানো দৃশ্য চোখে পড়ে খুব ভোরে আর সন্ধ্যায়। আর দিনের মিষ্টি রোদ কুয়াশাদের পরাজিত করে লুকিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে হালকা হিমেল বাতাস তাদের গা স্পর্শ

করে। এ যেন ঋতুকন্যা হেমন্তের বিদায় আর শীতের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। রাতের বেলায় দূর আকাশে রুপালি চাঁদ আলো ছড়িয়ে দেয়। দাদাদের বাঁশঝাড়ে জোনাকিদের মেলা বসে। দু-একটা জোনাকি উড়তে উড়তে বাড়ির আঙ্গিনায় সবুজ আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়ায়। সেই জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে লামিয়া ও নুর্সিয়া অন্য ভাই-বোনদের সঙ্গে জোনাকি ধরার জন্য মেতে ওঠে। রাকিব জোনাকি ধরে জামার পকেটের ভেতরে রেখে দেয়। জোনাকির সবুজ আলোতে তারা মুগ্ধ হয়। তাদের প্রাণটা আনন্দে নেচে ওঠে। লামিয়া দাদার কাছে জানতে চায়Ñজোনাকি পোকার দেহে আগুন জ্বলে কেন? ওই আলোতে কি জোনাকির শরীর পুড়ে যায় না? দাদা সবাইকে সামনে নিয়ে লামিয়ার প্রশ্নের উত্তর দেয়। দাদা বলেন : জোনাকি পোকার দেহে লুসিফারিন নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন হয়। এ লুসিফারিন বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়। তখন আমাদের কাছে মনে হয় জোনাকিরা দেহে আলো জ্বেলে আঁধার রাতে পথ চলছে। সারা বিশ্বে দুই ধরনের জোনাকি পোকা দেখা যায়। সবুজ আলোর জোনাকি আর লালচে আলোর জোনাকি। আমাদের দেশে শুধু সবুজ আলোর জোনাকি দেখা যায়। জোনাকি পোকার জীবনকাল ১ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। দাদার মুখে গল্প শুনে তারা অনেক কিছু জানতে পারে। এরপর রাতের খাবার খেয়ে তারা আবার ঘুমাতে যায়।

দাদাদের বাড়িতে বড় একটি ঢেঁকি আছে। শুধু বাড়ির লোকজনরাই নয়, আশপাশের প্রতিবেশীরাও ধানভানার জন্য দাদাদের বাড়িতে আসে। ভোরবেলা থেকে গাঁয়ের বৌ-ঝিরা ঢেঁকিতে ধান ভানে। ধানভানার শব্দে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। লামিয়া ও নুর্সিয়ার খুব শখ ঢেঁকিতে পাড় দেবে। একটু বেলা হলে তারা দাদির সঙ্গে ঢেঁকিতে পাড় দেয়। ঢেঁকিতে পাড় দিতে পেরে তারা খুব খুশি হয়। পাড় দেওয়া শেষ হলে রেশমা ওদের দুজনকে শিউলিতলায় নিয়ে যায়। সবুজ ঘাসের গালিচায় ছড়িয়ে থাকা শিউলিগুলোকে মনে হয় কে যেন আকাশের তারাগুলো ধরার বুকে ছড়িয়ে রেখেছে। তারা আনন্দচিত্তে ফুলগুলো কুড়িয়ে নেয়। বাড়িতে এসে শিউলি ফুলের মালা গাঁথে। সেই মালা পরে তারা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। দাদাদের পাশে হাদিদের বাড়িতে একটি কামরাঙাগাছ আছে। হাদি সবার জন্য কয়েকটি পাকা পাকা কামরাঙা পেড়ে আনে। আর মিরা আনে চালতার আচার। এগুলো খেয়ে ওদের খুব ভালোভাবেই দিনটা কেটে যায়।

গ্রামে হাফিজ চাচার বড় একটা ফুলবাগান রয়েছে। সেখানে নানা ধরনের ফুলের গাল রয়েছে। একদিন ফুফু ওই ফুলবাগানে ওদের সবাইকে নিয়ে যায়। গন্ধরাজ মল্লিকা, কামিনী, হিমঝুরি, ছাতিম দেবকাঞ্চন, বকফুল, গাঁদা, বনমল্লিকা, স্বর্ণচামেলী, রাজ অশোক আর গোলাপ ফুলের নয়নকাড়া রূপে তারা মুগ্ধ হয়। বাগানে রং-বেরঙের প্রজাপতি আর ফড়িংগুলো আনন্দচিত্তে উড়ে বেড়াচ্ছে। একসঙ্গে এতগুলো হেমন্তের ফুল তারা আগে কখনো দেখেনি। নবান্ন উৎসব উপলক্ষে গ্রামের হাটবাজারে গ্রাম্যমেলা বসে। দাদা অন্য একদিন সবাইকে মেলা দেখাতে নিয়ে যায়। মেলাতে তারা লাঠিখেলা দেখে, নাগরদোলায় চড়ে, বাঁশি ও বাউলগান শোনে। দাদা মেলা থেকে ওদের তিলের খাজা, কদমা ও বাতাসা কিনে দেয়। তারা সেগুলো খুব মজা করে খায়। এভাবে দেখতে দেখতে তাদের ছুটি শেষ হয়ে যায়। ঢাকা থেকে তার বাবা লামিয়াকে নিতে আসে। পরের দিন ভোরবেলায় তারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। এর একদিন পর নুর্সিয়ারাও খুলনায় চলে যায়। গ্রাম ছেড়ে তাদের মোটেও যেতে ইচ্ছে করেনি। বিদায় নেওয়ার সময় তাদের দুচোখ জলে ভরে যায়। দাদা-দাদি পরমাদরে চোখের জল মুছিয়ে দেয়। এবার হেমন্তের ছুটিতে যে আনন্দ উপভোগ করেছে তা তারা কখনো ভুলতে পারে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close