খুব মনোযোগ দিয়ে বই পড়ার অভ্যাস সেতুর। প্রত্যেকটা বিষয় বুঝে ও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে সে। এ কারণেই সেতু ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র এবং শিক্ষকদের কাছে প্রিয় পাত্র। যদিও ক্লাসে তার বন্ধু খুব কম! সে নিজেই কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় না, যদি কেউ নিজে থেকে আগ্রহ না দেখায়। কয়েক দিন ধরে সেতুর মাথায় একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যেন সেটার বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না। সে বই পড়ে কয়েক দিন ধরে একটি শব্দের মানে খোঁজার চেষ্টা করছে। ‘ছাদবাগান’। সেতুর আগেও গাছ লাগানোর প্রতি ঝোঁক ছিল। গত কয়েকবার বাবার সঙ্গে বৃক্ষমেলায় গিয়ে তার মধ্যে এ শখ তৈরি হয়েছে। কিন্তু শহরে ভাড়াবাসায় থাকার কারণে বাবা-মা আর খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। সে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে এবার নিজেই একটি ফুল ও একটি লেবু গাছ কিনে নিয়ে আসে। ছাদে গাছ লাগানোর কারণে ইদানীং এই গাছই তার নতুন বন্ধু হয়ে উঠেছে! তাই অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে তার ছাদে যাওয়া বেড়ে গেছে। তার মতো বয়সে যেটুকু ভালোবাসা-প্রেম-স্নেহ থাকা দরকারÑ সবটুকুই যেন তার ছাদবাগানকে ঘিরে। ছাদবাগানের গাছগুলোর সঙ্গে যেন তার নিত্যদিনের আবেগ-অনুভূতি খেলা করে। ছাদবাগান সেতুর দাদির খুব একটা পছন্দ নয়। পছন্দ নয় ঠিক তা নয়, বিকেললো সেতুর বারবার ছাদে যাওয়া আর দাপাদাপি করা দাদির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়।

সেতু একটা বিষয় নিয়ে খুব চিন্তিত। তার গাছ দুটি বড় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু গাছের সংখ্যা আর বাড়ছে না। একবার সেতুর দাদির মারাত্মক জ্বর হয়। কয়েক দিন পর জ্বর থেকে সেরে ওঠার পরও মুখ দিয়ে যা খায় তাই তেতো লাগে। ডাক্তার দাদিকে টক খাওয়ার পরামর্শ দেয়। সেতু তার গাছ থেকে লেবু পেড়ে নিয়ে দাদিকে দেয়। দাদির মুখে ধীরে ধীরে রুচি ফিরে আসে। এরপর থেকে সেতুর ছাদবাগানের প্রতি দাদির ভালোবাসা বেড়ে যায়। দাদি সেতুকে বলে, ‘আমিও তোমার সঙ্গে তোমার ছাদবাগান দেখাশোনা করব, বাগানের যতœ নিব।’ সেতু খুশি হয়। ছাদ বাগানের প্রতি আরো উৎসাহ বেড়ে যায় সেতুর। এত বড় ছাদটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে সেতুর। সেতু ভাবে, ‘বাগানে যদি আরো গাছ থাকত!’ এরপর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে সেতু প্রথম স্থান অধিকার করে। পুরস্কার হিসেবে আরো তিনটি গাছের চারা পায় সেতু। খুশিতে আত্মহারা সেতু ও তার দাদি।

সেতু ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে ওঠে। এরপর চলে গেল আরো কয়েক মাস। বর্ষাকাল চলে আসে। সেতুর স্কুলে স্থানীয় নগরবাসী ও স্কুল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ‘বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি’র আয়োজন করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে বক্তৃতার ওপর ‘বিশেষ পুরস্কারের’ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেতু অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতায় শহর এলাকায় বাসা-বাড়ির ছাদে বাগান করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। সেতু বলে, ‘নগরের প্রতিটি ছাদে বাগান করার উদ্যোগ নিলে নগরের সবুজায়ন যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি নগরবাসী প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারবে। নগরের প্রতিটি ছাদ হবে এক একটি সবুজ ক্ষেত্র। তাছাড়া প্রয়োজনীয় ফল ও সবজির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি মনও ভালো থাকবে।’ সেতুর বক্তৃতা শুনে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। সেতু বক্তৃতায় প্রথম স্থান অধিকার করে। আবারও পুরস্কার হিসেবে কতগুলো গাছের চারা পায় সেতু। সেতু এখন অনেক খুশি। তার উৎসাহ-উদ্দীপনা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। ছাদবাগান করার সুবাদে সেতুর পরিচিতি দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। স্কুলের সবাই এখন সেতুকে একজন ‘ছাদবাগানের বৃক্ষবন্ধু’ হিসেবে চেনে। যাদের বাড়ির সামনে গাছ লাগানোর কোনো জায়গা ছিল না, যাদের গাছ লাগানোর প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না তারাও এখন সেতুর দেখাদেখি বাসা-বাড়ির ছাদে বাগান করার তাগিদ অনুভব করছে। অন্যান্যরা এখন সেতুর খুব ভালো বন্ধু। ছাদবাগান করার ক্ষেত্রে সবাই এখন তার কাছ থেকে বিভিন্ন পরামর্শ নেয়। এমনভাবে দিন ভালোই কাটছিল। পড়ালেখার বাইরে সেতুর একটায় ভাবনা; যদি তার ছাদবাগানে গাছের সংখ্যা আরো বাড়ত তাহলে ভালোই হতো!

হঠাৎ সেতু দুদিন ধরে স্কুলে যাচ্ছে না। প্রধান শিক্ষক সেতুর বাবা-মার কাছ থেকে জানতে পারে সেতুর মন খারাপ। জানা যায়, সেতুর ছাদবাগানের ছোট ছোট দুটি নিম গাছ মরে গেছে। এ জন্য সে স্কুলে যায়নি! স্কুল কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিয়ে চিন্তাই পড়ে যায়। পরের দিন সকালে সেতু ছাদবাগানে গিয়ে দেখে তার বাগানে পাঁচটি নিম গাছের চারা হাজির। সেতু অনেক খুশি হয়। সেতু প্রধান শিক্ষকসহ স্কুল কর্তৃপক্ষকে গাছ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেতুর ছাদবাগানে গাছের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অনেকেই এখন সেতুর ছাদবাগান দেখতে আসে, প্রশংসা করে। অন্যরা উৎসাহিত হয়। সবার প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠে সেতু।

"