তুফান মাজহার খান
ডাংগুলি
রাফি খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে। সারা দিন পই পই করে ঘুরে বেড়ায় আর এর সঙ্গে ডাংগুলি খেলে। তার মা শত চেষ্টা করেও স্কুলে পাঠাতে পারে না। যদিও মাঝে মধ্যে ধরে বেঁধে স্কুলে নিয়ে যায় কিন্তু কোনো লাভ হয় না। স্কুলে দিয়ে আসার পর নানা অজুহাতে স্কুল থেকে চলে আসে। পেট ব্যথা, মাথা ব্যথাসহ আরো কতরকম বাহানা যে তার জানা আছে, তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। একদিন তো সে অজ্ঞানই হয়ে যায়। শিক্ষকরা মাথায় পানি-টানি দিয়ে জ্ঞান ফেরায়। সঙ্গে আরেকজন সহপাঠী মিরণকে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু বাড়িতে আসলে তো ভালোই হতো। বাড়িতে না এসে আধপথে এসে রাফি মিরনকে বলে, এই মিরন ডাংগুলি খেলবি? মিরন বলে, সেকি রে, তুই না অসুস্থ। রাফি বলে, ধুর, আমি আবার অসুস্থ হই নাকি? বাহানা করে ছুটি নিলাম আরকি। মিরন বলে, তুই তো ডাহা মিথ্যাবাদী। আমি তোর সঙ্গে খেলব না। রাফি বলে, আরে আয় না। অনেক মজার খেলা। একবার খেলেই দেখ।
শেষ পর্যন্ত মিরন খেলতে রাজি হয়। রাফি গাছ থেকে একটি ডাল ভেঙে দেড় হাত পরিমাণ একটি ডাং আর আধ হাত পরিমাণ একটি গুলি তৈরি করল। রাফির ডাংগুলি তৈরি করার দক্ষতা দেখে মিরন বেশ মুগ্ধ হলো। প্রথম প্রথম মিরনের খেলাটি বুঝতে একটু কষ্ট হয়। সে আগে কখনো এ খেলা খেলেনি। রাফি তার নানুর বাড়ি থেকে এ খেলা শিখে এসেছে। বলতে গেলে সেই এলাকায় প্রথম এ খেলার উদ্ভব ঘটায়। এখন পাড়ার অনেক ছেলেই এ খেলায় ওস্তাদ হয়ে গেছে।
রাফি মিরনকে এক এক করে খেলার সব নিয়মকানুন শিখিয়ে দেয়। রাফি বলে, এই যে এখানে একটু মাটি গর্ত করলাম। এবার গর্তের ওপরে আড়াআড়িভাবে গুলিটা রাখতে হবে। তারপর গুলির নিচে ডাংটা ঢুকিয়ে দ্রুত খানিকটা ওপরে তুলে সাঁই করে সজোরে একটা বারি মারতে হবে। তারপর যেখানে গিয়ে গুলিটা পড়বে সেখান থেকে সোজা ডাং ফেলে ফেলে এক দুই গুনে গর্ত পর্যন্ত আসতে হবে। পয়েন্টের একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা থাকবে। অর্থাৎ লক্ষমাত্রা পাঁচশো বা এক হাজার অথবা এর কম-বেশি একটা সংখ্যা খেলা শুরুর পূর্বেই নির্ধারণ করে নিতে হয়। তারপর এভাবে পয়েন্ট করতে করতে যে আগে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে, সে-ই হবে বিজয়ী।
রাফির কথা মিরনের কাছে প্রথম হযবরল মনে হলেও দু-এক দান খেলার পর বেশ আয়ত্ত করে ফেলেছে সে। সত্যি সত্যিই মিরনের কাছে খেলাটি বেশ লাগে। আজ প্রথম খেলেই সে যেন পাক্কা প্লেয়ার হয়ে উঠেছে।
দিনভর তারা ডাংগুলি খেলল। খেলতে খেলতে মাথার ওপর থাকা কড়া সূর্যটা কখন যে ঢলে পড়ে নিস্তেজ হয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল করল না কেউই। খেলার নেশায় পেটের ক্ষুধাও যেন ছুটি নিয়েছে। স্কুল শেষে তাদের গণিতের শিক্ষক হক স্যার হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ তার নজরে এল রাফি আর মিরন ডাংগুলি খেলছে। পরনে স্কুল ড্রেস। স্যারের বুঝতে বাকি রইল না যে, সকাল থেকে এখনো বাঁদর দুটো বাড়ি ফেরেনি। আর নিশ্চই রাফি সকালে ভং ধরেছিল। দাঁড়া আজ দেখাচ্ছি মজা বলে হক স্যার তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। হক স্যারের আগমন টের পেয়ে ডাংগুলি ফেলেই ছুট লাগাল দুজন।
রাতে হক স্যার রাফিদের বাড়ি গেলেন। পুরো ঘটনা খুলে বললেন। রাফির মা শুনে তো অবাক! ঘটনা শুনে রাফির বাবা লাঠি হাতে নিলেন ছেলেকে শায়েস্তা করতে। কিন্তু হক স্যার বাধা দিলেন। স্যার বললেন, থাক মারবেন না। মেরে তো লাভ নেই। আর মারলে ফলাফল ভালো হয় না বরং সন্তান ভয় পাওয়ার পরিবর্তে আস্তে আস্তে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তারচেয়ে বরং ছেলেকে বোঝান। বুঝিয়ে বললে আশা করি ভালো ফল পাবেন।
কথাগুলো বলে স্যার উঠতে যাবেন অমনি রাফির বাবা বলল, স্যার এখন যেতে পারবেন না। আমাদের সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে তারপর যাবেন। স্যার মৃদু হাসলেন এবং পুনরায় বসলেন। রাফিকে কাছে টেনে একটু আদর করে বললেন, শুনো বাবা, জীবনে বড় হতে হলে পড়ালেখার বিকল্প নেই। যে যত পড়বে সে তত বড় হতে পারবে। তুমি বড় হতে চাও না? রাফি হ্যাঁসূচক অর্থে মাথা নাড়ল। স্যার আবার বললেন, হ্যাঁ খেলাধুলা করবে। খেলাধুলা করতে তো নিষেধ নেই। খেলাধুলা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ছুটির দিনে খেলবে, স্কুল থেকে ফিরে এসে বিকালে খেলবে তাহলেই তো হলো। স্কুল ফাঁকি দিয়ে খেলতে হয় নাকি? আর দুপুরের কড়া রোদে খেলাধুলা করাও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ক্ষতিকর। এ সময় সূর্য থেকে নেমে আসে অতি বেগুনী রশ্মি; যা আমাদের দেহ এবং ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। রাফি স্যারের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে।
পরদিন থেকে সে আর স্কুল ফাঁকি দেয় না। প্রতিদিন স্কুলে যায়। প্রথম বেঞ্চে বসে। হঠাৎ রাফির এত পরিবর্তন দেখে তার সব বন্ধুরাও তাকে অনুসরণ করতে থাকে। সব শিক্ষকরাও তাকে আদর করে। একদিন রাফি অনেক
বড় হয়।
"