শামীম শিকদার

  ২৫ আগস্ট, ২০১৮

গল্প

ম্যাজিক স্যার

শীতকাল, খুব ভোর থেকেই বাইরে ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে। মাঠের একপাশে দাঁড়ালে অন্যপাশে কে দাঁড়িয়ে আছে তা বোঝা মুশকিল। ঘর থেকে বের হলেই মাথা ভরে যায় শিশিরে। ঘরের টিনের চালে শিশির পড়ার শব্দ মাঝে-মধ্যে বৃষ্টি পড়ার শব্দের মতো মনে হয়। প্রতিদিন তন্ময় খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলেও আজ এমন দিনে তার ওঠার কোনো নাম নেই। গায়ে কম্বল জড়িয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সে। এদিকে তার মায়ের বকুনি, ছেলেটির স্কুল আছে এখনো ঘুমাচ্ছে, কখন যাবে সে। মায়ের বকুনিতে আর রক্ষা নেই, কানের কাছে এ রকম ব্যান ব্যান করলে আর যাই হোক ঘুমানো কি আর যায়। বাধ্য হয়ে তন্ময়কে উঠতে হলো। গায়ে পাতলা একটি কম্বল জড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করে সকালের নাশতা খেতে সবার সঙ্গে বসেছে। তন্ময়ের বোন তানিহা বলে ভাইয়া তুমি এতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকো কীভাবে? আমার তো ঘুমই আসে না। এবার তন্ময় তার বোনের প্রশ্নের উত্তরে বলে। আরে ঘুমাব কেন আমি তো সেই কখন থেকেই সজাগ কিন্তু অতিরিক্ত শীতের কারণে কোনোভাবেই উঠতে ইচ্ছা করছিল না, তাই কম্বল নিয়ে শুয়ে ছিলাম। তন্ময়ের প্রতিটি কথার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ দিয়ে সাদা ঘুলাটে ধোঁয়া বের হচ্ছে দেখে তানিহাও তা করার জন্য চেষ্টা করছে। সকালের নাশতা করে দুজন স্কুলের উদ্দেশে রওনা দিল বাড়ি থেকে।

তন্ময় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে আর তার ছোট বোন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। দুজন দুজনের স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আশপাশে কে দাঁড়িয়ে আছে তা বোঝা যায় না। একটু কাছে হলে মনে হয় কোনো ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। সপ্তম শ্রেণির ক্লাসের ভেতর তন্ময় কাউকে বসে থাকতে দেখল। কাছে যেতেই দেখল ক্লাসের এক কোনায় বসে আছে সোজাতা। সে বসে আছে একদম জড়োসড়ো হয়ে। তার বসাতে কোনো নড়াচড়া নেই। কাছে গিয়ে তন্ময়ও বসল। তারও কিছুটা শীত অনুভব হচ্ছে। সূর্যমামার কোনো খোঁজ নেই। বাজতে বাজতে সকাল ১০টা। তবু কুয়াশা কমার কোনো নাম নেই। সকাল সকাল ক্লাসে ছাত্রছাত্রী তেমন হয় না আবার যেদিন সকাল সকাল কুয়াশাকে আড়াল করে সূর্যমামা দেখা দেয়, সেদিন সবাই উপস্থিত থাকে। একটু রোদের আশায় ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে ছাত্রছাত্রীরা। তন্ময়ের প্রথমেই বাংলা ক্লাস। ম্যাজিক স্যার ক্লাসে প্রবেশ করতেই সবাই একেবারে নীরব হয়ে গেছে। ত্রিশ মিনিটের ক্লাসে যতক্ষণ স্যার থাকবেন, ততক্ষণ সবাই চুপ থাকবে। তার মূল কারণ হচ্ছে, স্যারের কথাগুলো খুব সুন্দর ও গুছালো। স্যার যখন ক্লাস নেন, তখন শুধু বই থেকেই নয়, বইয়ের বাইরে থেকেও অনেক আলোচনা করেন। অনেক সময় অনেক ধরনের মজার মজার গল্পও বলেন। তাই সব সময় ছাত্রছাত্রীরা এই স্যারের ওপর সন্তুষ্ট থাকে। স্যারের এমন স্বভাবের জন্য স্যারের নাম দেওয়া হয়েছে ম্যাজিক স্যার। স্যার ছাত্রছাত্রীদের হাসাতে খুব বেশি রকমের পটু। যেকোনো কারণেই হোক কারো যদি মন খারাপ থাকে, তবে সে স্যারের ক্লাসে উপস্থিত থাকলে সব ঠিক হয়ে যায়। তার না হেসে কোনো উপায় নেই। স্যারের বলার ভাষাগুলো খুব বেশি রসাত্মক। স্যার কথা বললে মনে হয় স্যারের কথাতে রসে ভরা। অন্যান্য স্যারের ক্লাসে ছাত্রছাত্রী তেমন উপস্থিত না থাকলেও স্যারের ক্লাসে সবাই উপস্থিত থাকবে। এমনও ঘটনা ঘটেছে, যেখানে অনেক ছাত্র স্কুলে আসেনি, এমনকি হাজিরা খাতায় নাম উঠেনি, তবু স্যারের ক্লাসে তারা উপস্থিত। স্যার পাঠদানে যেমন পটু, তেমনি পটু ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করতে। বিশেষ করে স্বপ্ন দেখাতে কোনো দিক দিয়ে কম নয়। প্রায় সময়ই ক্লাসে স্যারের নির্ধারিত প্রশ্ন, বড় হয়ে কে কী হতে চাও? স্যারের এমন প্রশ্নের উত্তরে অনেকে অনেকটা বিব্রতবোধ করে। আবার কেউ চট করে উত্তর দিয়ে ফেলে। তন্ময়কে প্রায় সময় এ প্রশ্নটির সম্মুখীন হতে হয়। তার এক উত্তর, স্যার বড় হয়ে কী হব এখন তা জানি না। তখনই শুরু হয়ে যায় স্যারের বকুনি, জানবি না কেন? লক্ষ্য না থাকলে কিছু করা যায় না। এখন যা লক্ষ্য থাকে তা শতভাগ পূরণ না হলেও তা আশিভাগ পূরণ হবেই, যদি সেই লক্ষ্যে শতভাগ প্রখরতা থাকে। স্যারের এমন কথার পর প্রশ্নের সোজা উত্তর দেয় সে, স্যার আমি শিক্ষক হব। পরে শুরু হয়ে যায় স্যারের দ্বিতীয় প্রশ্ন? কেন শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিলি? তন্ময়ের উত্তর একটিই, শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা, তারা হচ্ছে সমাজ গড়ার কারিগর।

সব ছাত্রছাত্রী স্যারের প্রতি আকৃষ্ট থাকলেও তন্ময় ব্যক্তিগতভাবে স্যারের প্রতি একটু বেশিই আকৃষ্ট। স্যারকে সে যেমন সম্মান করে, তেমন ভালোবাসে। কারণ তার উচ্চ বিদ্যালয়ের এই দুই বছর জীবনে স্যারকে কখনো অলসতার মধ্যে দেখেনি। মেঘ, বৃষ্টি, ঝড় কোনো কিছুই স্যারকে আটকে রাখতে পারেনি, এমনকি আজকে এমন কনকনে শীতের মধ্যেও স্যার চলে এসেছে। এখনো স্কুলে অনেক স্যারের আসার কোনো নাম-গন্ধও নেই। তারা শুধু ক্লাসের সময় হলে এসে হাজিরা দেয়। প্রাইভেট বাণিজ্য প্রতিটি স্যারের পেশার সঙ্গে মিশে গেছে। ক্লাসে এসে কোনো বিষয় সম্পর্কে তারা পুরোপুরি আলোচনা করে না। অর্ধেক আলোচনা করে বলে প্রাইভেটে বাকিটা আলোচনা হবে। যার ফলে যাদের স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার উদ্দেশ্য নেই। বাধ্য হয়ে তাদেরও পড়তে হয় স্যারের কাছে প্রাইভেট। কিন্তু ম্যাজিক স্যার পুরো বিষয়টি আলোচনা তো করবেনই, তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের তুলনা করে ছাত্রছাত্রীদের বুঝিয়ে দেবেন। শুধু তা-ই নয়, স্যারের পড়ার মধ্যে নেই কোনো ক্লান্তি। সবাই আনন্দের সঙ্গে ক্লাস উপভোগ ও উপলব্ধি করে। স্যারের এমন গুণের কারণেই হয়তো স্যার তিন তিনবার পুরস্কার পেয়েছেন। তা ছাড়া স্যারকে পুরো গ্রাম চিনে ম্যাজিক স্যার নামে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close