অনার্য মুর্শিদ

  ১৮ আগস্ট, ২০১৮

রস কদম

মেঘ! ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে আইমান। মনে হচ্ছে, মেঘের পাহাড়টা এই বুঝি ধরে ফেলল। বাসাটা আর ক’তলা উঁচু হলে ধরেই ফেলত। আইমান দেখছে, একটা কালো মেঘের পাহাড় সাদা মেঘকে ঢেকে দিচ্ছে। কালো মেঘ দেখলে মন খরাপ হয়। কালো মেঘে বৃষ্টি হয়, বিকেলের খেলা জলে যায়। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে, একটু পর বৃষ্টি নামবে। হলোও তা-ই। সে কি ঝুম বৃষ্টি! সব ভিজে একাকার। আইমান বারান্দা থেকে ফেরে।

আইমানের বাবা টিভি দেখছেন। বর্ষার ফুলের ওপর প্রতিবেদন চলছে। তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখছেন। কেয়া, কদম, জুঁই, চাঁপা, গন্ধরাজ কত রকমের ফুল! আইমান এগুলোর কোনোটি দেখেছে, কোনোটি দেখেনি। কদম দেখিয়ে বাবা প্রশ্ন করেন, এগুলো কী ফুল বল তো?

আইমান বলল, কেন কদমফুল!

বাবা বললেন, কদমের ঘ্রাণ ভালো লাগে তোমার?

আইমান একটু হেসে বলল, আমি তো কখনো কদমফুল শুঁকে দেখিনি! আমি শুধু বইতে দেখেছি।

বাবা আশ্চর্য হয়ে বললেন, কী বলো! তুমি বই ছাড়া কদম দেখনি!

আইমান বলল, দেখব কী করে! ঈদ ছাড়া আমি কি কখনো গ্রামে গিয়েছি? কোনো বর্ষায় তো আমকে গ্রামে নাওনি!

বাবা বললেন, তাই তো! চলো এই শুক্রবারই আমরা গ্রামের বাড়ি যাই। কদম দেখব। সোঁদা মাটির গন্ধ শুঁকব।

আইমানের মা রান্নাঘর থেকে স্বামীকে শাসিয়ে বললেন, কী সব আজেবাজে বোঝাচ্ছ ছেলেকে! মাটির গন্ধ শুঁকবে! মাটির গন্ধ আবার শুঁকার কী আছে!

আইমান খেয়াল করেছে মায়ের ধমকে বাবা শিশুর মতো হয়ে গেছেন। মাঝে-মাঝে বাবা-মায়ের এমন দৃশ্য দেখে আইমান হাসে। কিন্তু এখন বাবার মনের অবস্থা বোঝা যাচ্ছে না। মুখের ভাব বদল হচ্ছে। একটু পরই হয়তো বজ্রমূর্তি ধারণ করবেন।

ভাবতে না ভাবতে তাই হলো।

বাবা একটু চেঁচিয়ে বললেন, সোঁদা মাটির তুমি বুঝবে কী? আজীবন তো পোড়ামাটি আর চীনামাটির ভেতরে কাটিয়ে দিলে! কত করে বললাম ছেলেকে নিয়ে গ্রামে চলে যাই। সেখানেও এখন ভালো স্কুল আছে, খেলার মাঠ আছে, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ আছে, বিশুদ্ধ খাবার আছে।

মা একটু কোমল হয়ে বললেন, শহরে যে সুযোগ-সুবিধাগুলো আমরা পাচ্ছি, গ্রামে কি তা পাব? তোমার একটা ভালো চাকরি, গ্রামে গেল তুমি এটা পাবে?

বাবা বললেন, গ্রামে গেলে এ চাকরি হয়তো পেতাম না কিন্তু আরো ভালো কিছু করতে পারতাম। উৎপাদন করতাম, চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করতাম। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়। প্রয়োজনের তাগিদে আমরা এখানে বসবাস শুরু করেছি কিন্তু মাথায় রাখা উচিত আমাদের মূল শেকড় গ্রাম।

আইমানের মা আর কথা বললেন না। কারণ এ কথা স্বামী তাকে অনেকবার বুঝিয়েছেন। তিনিও এখন এক-আধটু বুঝতে শিখছেন।

শুক্রবার দিন সকাল বেলা।

বাবা-মায়ের সঙ্গে আইমান গ্রামের উদ্দেশে বের হলো। থেমে থেমে বৃষ্টি, গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া রাস্তা, ভালোই লাগছে আইমানের। বাবা শাস্ত্রীয় সংগীত শুনছেন, মায়ের চোখে একটু একটু ঘুম। এই করতে করতে তারা গ্রামে পৌঁছে যায়।

তখন দুপুর। গাড়ি থেকে নেমে তারা যখন বাড়ির পথে ঢুকছিল, হঠাৎ পুকুর পাড়ে কয়েকটি কদমগাছ চোখে পড়ল তাদের। কিন্তু শূন্য গাছ, ফুল নেই। মৌ সন্ধ্যার মতো কদমফুলও যেন জীবনে একবার ফুটে এখন! আইমানের বাবা বাড়ির লোকজন থেকে জানলেন, এ বছর নাকি কদম ফোটেনি। গত কয়েক বছর এমনটি হচ্ছে। শুনে তিনি অবাক হলেন। বর্ষায় কদম ফোটে না! এ কেমন কথা!

সন্ধ্যাবেলা।

গ্রাম থেকে শহরে ফিরছে তারা। বাবা গম্ভীর হয়ে আছেন দেখে মা বললেন, কী হলো অমন গম্ভীর হয়ে আছো যে!

বাবা বললেন, এই জিনিস কি মানা যায়! এ রকম একটা বর্ষা চলে যাচ্ছে অথচ কোথাও একটা কদমের দেখা নাই! কি আশ্চর্য!

মা বললেন আমিও আশ্চর্য! তবে সেটা কদম নিয়ে না, তোমাকে নিয়ে। আশ্চর্য হওয়ার তুমি আর বিষয় পেলে না! এসব আজগুবি বিষয় তোমার মাথায় কেন আসে? এগুলো নিয়ে তো পরিবেশবিদরা ভাববে? তুমি ভাববা দুই টাকা কীভাবে বেশি রোজগার করা যায়। সংসারের কীভাবে আরেকটু আয় উন্নতি করা যায় এসব...।

বাবা বললেন, পরিবেশ ও জলবায়ু ভালো না থাকলে মানুষের মাঝে বড় বড় রোগের জন্ম হয়। এখনকার মানুষের গড় আয়ু কমার এটাও একটা কারণ। একটা সময় বাংলাদেশকে ছয় ঋতুর দেশ বলা হতো। আর এখন! গ্রীষ্ম আর শীত। বিশ বছর পর হয়তো একটা ঋতুই থাকবে। হয় শীত, না হয় গ্রীষ্ম। তখন কদম কেন, আরো কত কিছু থেকে যে বঞ্চিত হব আমরা! আম-কাঁঠালের কথা ভাবো। গ্রামে কোথাও একটা আম দেখছ? যে হারে ইটভাটা বাড়ছে, পরিবেশ দূষণ হচ্ছে বৃষ্টি হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। হলেও দূষিত বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি না হলে আম আসবে কোত্থেকে, কাঁঠাল আসবে কোত্থেকে! অতএব ফরমালিনের আম খাও, ফরমালিনের জাম খাও! এই আকাশ, এই মাটি, এই পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সবারই কর্তব্য। নতুবা আমরা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ থাকব।

বাবা-মায়ের কথা শুনতে শুনতে আইমান প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝপথে একটি রেস্টুরেন্টের সামনে তাদের গাড়ি বিরতি নেয়। আইমানের বাবা তাকে জাগাল।

তিনজন রেস্টুরেন্টে ঢোকে। রেস্টুরেন্টে ঢোকার পথেই সাজানো রয়েছে বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি। আইমান বাবাকে একটি হলুদ রঙের রসকদম দেখিয়ে বলল, বাবা কদমফুল!

বাবা তাকিয়ে দেখেন, মিষ্টিটাকে সত্যিই কদম ফুলের মতো দেখাচ্ছে।

তিনি মিষ্টিটা নিয়ে ছেলের মুখে পুরে দিলেন। আইমান মিষ্টি খেতে খেতে বাবাকে বলল, বাবা কদমফুল বুঝি মিষ্টি হয়! আইমানের বাবা, মা দুজনই নিরুত্তর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close