মো. মেহেদী হাসান
তিতিরের ফল খাওয়া
তিতির-সুজন দুই ভাই। একজন ক্লাসের প্রথম ভাগের ছাত্র। আরেকজন গোবোরে গণেশ। সুজন ভালো ছাত্র, সে সব সময় পড়াশোনা আর তিতিরের ভুল ধরা নিয়ে ব্যস্ত। বাবা-মায়ের আদরের শেষ সন্তান তিতির। ছোট বলে আদর একটু বেশিই পায় সে। বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিলেন ‘তিতির’। নামটি পাখির হলেও তার তাতে আপত্তি ছিল না। বন্ধুরা সবাই তিতির পাখি বলেই ডাকত। বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিল বিপুল। তার নাম যেমন বিপুল, তার মনও তেমন বিপুল। ভালো বন্ধুত্বের তালিকায় আরো ছিল চন্দন, অমিত, সৌরভ, প্রশান্ত। সময় কাটে প্রতিটি মুহূর্ত এসব বন্ধুর সঙ্গে। বাবা-মায়ের আদরের সঙ্গে সঙ্গে শাসনের কোনো কমতি ছিল না তার। বাবার কথা : ‘খেলাধুলা, আড্ডা সবকিছু হবে দিনে, সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে বাসায় উপস্থিতি চায়। মায়ের কাছে কিছু ছাড় পাওয়া যেত। তিতির তখন ক্লাস এইটে পড়ে। এমন সময় একদিন বিপুল বলে বসল, ‘তিতির আজ রাতে লিচু চুরি করতে যাব।’ সে হকচকিয়ে গেল। উত্তরে বলল, ‘কেউ যদি টের পেয়ে যায়?’ বিপুল বলল, ‘সে বিষয়ে তোর টেনশন (চিন্তা) করার কোনো প্রয়োজন নেই, সব দায়িত্ব আমার। যেমন কথা তেমন কাজ। রাতের পড়া তাড়াতাড়ি সেরে ফেলে মা-বাবা এবং সুজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা। বাবার চোখে ফাঁকি দিতে পারলেও সুজনকে ফাঁকি দেওয়া গেল না। রিতিমতো সে দেখতে পেয়ে গেছে। অনেক শর্তের পর বাড়ি থেকে বের হতে পারল তিতির। বের হয়েই দেখতে পেল বন্ধুরা বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ঠিক করল খালেক চাচার লিচুগাছ। কিছুক্ষণের মধ্যেই যাওয়া হবে ঝোপের আড়ালে সেই লিচুগাছটির কাছে। চন্দন এবং সৌরভকে তারা রাখল প্রহরীর দায়িত্বে। তিতির, অমিত আর প্রশান্ত তিনজন গেল গাছতলায়। গাছের উচ্চতা খুব একটা ছিল না। একজন অপরজনকে ছেড়ে রাখলেই লিচু নাগালের মধ্যে চলে আসবে এমন উচ্চতা। এমন সময় চটজলদি মাথায় একটা বুদ্ধি কাজ করল তিতিরের। অমিত তিতিরকে কাঁধের ওপর তুলে নিল আর তিতির সহজেই লিচু পেড়ে নিল। তাড়াহুড়ো করে লিচু পেড়ে ব্যাগবোঝায় করল সবাই মিলে, তারপর ঝোপের মধ্যে বসে সবাই মিলে নিমিষেই শেষ করে দিল সবগুলো লিচু। কিছু লিচু রেখে দেওয়া হলো সুজনের জন্য। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যে যার মতো বাড়ি ফিরে গেল। তিতির তার সঙ্গে নিয়ে গেল কিছু লিচু সুজনের জন্য। তা দেখে সুজন খুব খুশি। চুরি করার অভিজ্ঞতা এই প্রথম, এক রাতে এভাবে চুরি করে লিচু খেতে পারবে তিতির স্বপ্নেও ভাবেনি। বিপুল সবকিছু সামলে নিয়েছিল, সে বুদ্ধিমান একটা ছেলে। সকালবেলা মায়ের বকুনি খেয়ে সময়মতো স্কুলে চলে গেল তিতির। চুরি করতে যাওয়ায় রাতে ঘুমাতে পারেনি সে। প্রথম পিরিয়ডে বাবলু স্যারের ক্লাস। এই স্যার খুব কড়া, স্যারের ক্লাসে ভয়ে কেউ কথা বলে না। কারণ সবাই জানে, কথা বললেই স্যার পড়া ধরবে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। চন্দন পড়া পারবে কি? কানে কানে বলতে গিয়ে স্যার দেখে ফেলেছে তিতিরকে। এবার কী হবে? আজকে তো পড়া পারব না মনে মনে ভাবছে তিতির। স্যার সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে চলে এলো। চশমার ফ্রেমের ওপর দিয়ে তাকিয়ে তাকে বলল, ‘কিরে কথা বলছিস কেন?’ সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, এ প্লাস বি হোলস্কোয়ারের সূত্রটা বল? সে হতবাক হয়ে গেল, কোনো কথা বলল না। স্যার বলল, পড়া করিসনি কেন রে? তিতিরের কোনো উত্তর নেই। মনে হচ্ছে সে যেন একজন বাক-প্রতিবন্ধী। স্যার বললেন, ‘ছোখ লাল কেন রে তোর, রাতে চুরি করতে গিয়েছিলিস?’ তিতিরের কথা কেমন জানি আটকে যাচ্ছিল। সে বলল না, মানে, ইয়ে স্যার, জি স্যার, না স্যার। স্যার কঠোর কণ্ঠে বলল, ‘কিরে তোতলাচ্ছিস কেন, ঠিক করে বল, হ্যাঁ কী না?’ সে সাহস নিয়ে বলল, না স্যার। তার কথা শুনে মেয়েরা হেসেই ফেলল। শেষ পর্যন্ত কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল। প্রথম পিরিয়ড শেষে বন্ধুরা সবাই তিতিরকে জোঁকের মতো ধরে বলল, ‘আর একটু হলেই দিতিস তো সব খুলে।’ বরাবরের মতো সেদিন ও ক্লাস শেষে আলোচনা শুরু। আলোচনার শুরুতেই কথা উঠল, কালকের মতো আজকেও কিছু একটা চুরি করে খাবে তারা। যেমনি কথা তেমনি পরিকল্পনা শুরু। এমন সময় প্রশান্ত বলে উঠল, আজ লালচান চাচার গাছের ডাব চুরি করে খাব। সবার মতামতের ভিত্তিতে প্ল্যান কমপ্লিট করা হলো। রাত দশটা বাজে, বন্ধুদের নিয়ে স্পটে হাজির হলো তিতির। বিপুল গাছে চড়ায় পারদর্শী। তার বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য তাকেই গাছে তুলে দিয়ে সবাই নিজের পজিশনে পাহারায় দাঁড়িয়ে গেল। ডাবগাছটির উচ্চতা কম হওয়ায় সহজেই গাছের চূড়ায় পৌঁছানো গেল। দু-তিনটা ডাব পাড়তে না পাড়তেই রাস্তায় একজন মানুষ দেখা গেল। আসলে লালচান চাচা আসছিল। শব্দ সংকেতের মাধ্যমে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হলো। এদিকে চাচা টের পেয়ে গেছে। গাছের কাছে হাতের টর্চ লাইট জালিয়ে বলল, ‘কে গাছে, গাছে কে’ কোনো কথা নেই। এলাকা কিছুক্ষণের মধ্যেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বিপুল কিছুদূর নেমে এসে গাছ থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল। দলবলসহ সবাই ভোঁ দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেল। পরিকল্পনায় একটা ভুল ছিল, পালানোর সময় গাছের নিচেই স্যান্ডেল রেখে চলে এসেছে বিপুল। চাচা যদি জানতে পারে? তাহলে আমাদের বাড়িতে বলে দেবে। লালচান চাচা আসলে আমাদের শনাক্ত করতে পারেনি। সেবারের মতো বেঁচে ফিরল তিতিরের দলবল। সকলেই ওয়াদাবদ্ধ হলো আর কোনো দিন চুরি করবে না তারা। তারপর বাসায় গিয়ে পরদিনের বাবলু স্যারের পড়া কমপ্লিট করল তিতির, যাতে করে পরের দিন তোতলাতে না হয় তাকে। তবে, চুরি করতে গিয়ে ধরা না পড়লেও জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সেই স্মৃতিময় শৈশব মনে থাকবে তার।
"