কবির কাঞ্চন

  ২৮ জুলাই, ২০১৮

গল্প

ভেজা পাখি

সারা রাত টিপটিপ বৃষ্টি ঝরে। ফজরের আজানও ঈশাতের কানে বাজেনি। রাতে বেশ ঘুম হয়েছে। সকাল আটটায় ওর ঘুম ভাঙে। শরীরে বেশ ফুরফুরে ভাব আসে। এক পা, দুই পা করে জানালার পাশে এসে ও বাইরে তাকালো। এখনো আকাশজুড়ে ঘন মেঘের সরব উপস্থিতি। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। বারান্দার টবের গাছগুলোও যেন নবরূপে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। হঠাৎ করে একটি ময়না পাখি উড়ে এসে ওদের ব্যালকুনিতে বসতেই সেদিকে চোখ যায় ঈশাতের। পাখিটি বৃষ্টিতে ভিজে প্রায় কুপোকাত। দেখে মনে হচ্ছে উড়বার শক্তি হারিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এমন সব ভাবনা থেকে ব্যালকুনির দিকে এগিয়ে আসে ঈশাত। খুব সাবধানে পাখিটিকে ধরতে হাত বাড়ায় সে। পাখিটি উড়বার চেষ্টা না করে তার কাছে খুব সহজে ধরা দেয়। ঠিক অসহায় মানুষের মতো।

এমনিতেই পাখির প্রতি তার অঢেল ভালোবাসা। দীর্ঘদিন ধরে একটি পাখি পোষার শখ মনের মধ্যে পুষে আছে। ভেবেছিল আসন্ন কোরবানির ঈদে বাবার কাছে ঈদ উপহার হিসেবে সে একটি পাখি চাইবে। তারপর সেই পাখিকে চোখে চোখে রাখবে। নিজের হাতে খাওয়াবে। বাবা-মা অফিসে চলে গেলে পাখির সঙ্গে মনের কথা বলবে। আস্তে আস্তে পাখিকে কথা শেখাবে। পুরোপুরি পোষ মানলে স্কুলে নিয়ে গিয়ে রকিবকে দেখাবে। রকিব তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পড়াশোনায় ঈশাতের মতো ভালো। ক্লাসে কখনো ঈশাত ফার্স্ট হয়। আবার কখনো রকিব। ওদের সবকিছুতে মিল থাকলেও একটা জায়গায় মিল নেই। আর তা হলো রকিব একটি টিয়া পাখি পোষে। প্রায়ই স্কুলে নিয়ে আসে। পাখিটি খুব সুন্দরভাবে রকিবের নাম ধরে ডাকে। কী সুন্দর লাগে! সেই থেকে তার মনে একটি পাখি পোষার আকাক্সক্ষা জাগে।

ময়না পাখিটি নিয়ে এক দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে আসে। এরপর চুলো জ্বালিয়ে দিয়ে পাশে পাখিটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে পাখিটি স্বাভাবিক হয়ে নড়াচড়া শুরু করল। পাখিটিকে উৎফুল্ল হতে দেখে ঈশাতের খুব ভালো লাগে। সে মায়ের কাছে এসে আনন্দে বলতে লাগল-এই দেখো মা, আমি একটি ময়না পাখি ধরেছি। ঈশাতের মা অবাক হয়ে বললেন, কীভাবে ধরেছিস, বাবা! ওরা তো সহজে কারোর কাছে ধরা দেয় না।

-আল্লাহ ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। ওকে আমি পুষব। কথা শেখাব। আমার মতো করে তোমাকে ‘মা’ বলতে শেখাব।

-আর!

-আর কোনোদিন আমি মারা গেলে আমার বদলে ও তোমাকে ‘মা! মা!’ বলে ডাকবে। তখন আমার কথা তোমার মনে পড়বে। মুনমুন খাতুন ঈশাতকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, -এমন কথা কখনো মুখে আনবি না। তুই তো আমার প্রাণ। তুই না থাকলে আমি কেমন করে বাঁচব।

-মা! মাগো! আমি তোমার বুকে লুকিয়ে থাকতে চাই। এ কথা বলে ঈশাত মায়ের শাড়ির আঁচলে মুখ লুকায়।

পরদিন মাহফুজ চৌধুরী ছেলের জন্য পাখির হাট থেকে একটি সুন্দর খাঁচা নিয়ে আসেন। বাবার কাছ থেকে খাঁচাটি পেয়ে তার সে কী আনন্দ! খাঁচাটি নিয়ে একদৌড়ে ময়নার কাছে আসে। পরম যতেœ দরজা খুলে পাখিটিকে খাঁচার ভেতরে ছেড়ে দিয়ে বাইরে থেকে তাকিয়ে রইল। খাঁচার মধ্যে পাখিটি বড় বড় চোখ করে এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে। ঈশাত বুঝতে পারে-পাখিটি কোনো বন্দি মানুষের মতো অস্বস্তি অনুভব করছে। পাখিটির জন্য ওর

খুব মায়া হয়।

দৌড়ে মায়ের কাছ থেকে পাখির খাবার নিয়ে আবার ফিরে আসে। পাখিকে খুব আদর করে নিজ হাতে খাবার খাইয়ে খাঁচাসুদ্ধ বারান্দায় চলে আসে সে। বারান্দার এককোণে নিচে কাঠ বসিয়ে তার ওপর খাঁচাটি রাখল। এরপর খাঁচার আরো কাছাকাছি এসে পাখিটির দিকে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, এখন থাকো। আমি স্কুলে যাচ্ছি। স্কুল থেকে ফিরে এসে তোমাকে আবার সময় দেব। টা-টা, বন্ধু। কিন্তু পাখিটি কোনো শব্দ না করে ঈশাতের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ঈশাতের মনে হলো-ওকে তো এখনো কথা শেখানো হয়নি। তাই উত্তর দেয়নি। কেবল দাঁড়িয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। স্কুল থেকে ফিরে এসে কোনোমতে ব্যাগটা পড়ার টেবিলে রেখে ময়নার কাছে ছুটে আসে সে। পাখির খাঁচার ভেতরে লক্ষ করে দেখে। ছোট প্লেটটিতে কোনো খাবার নেই। পাখিটি বড় বড় চোখে ঈশাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশাত প্লেটটা নিয়ে মায়ের কাছে আসে। কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে আবার পাখির কাছে চলে আসে। নিজ হাতে পাখিকে খাবার খাইয়ে পাখির সঙ্গে কথা বলে। অনেক কথা। কথা যেন ফুরায় না। কিন্তু পাখিটি নিশ্চুপ থেকে সব বুঝতে চেষ্টা করছে। এভাবে দিন যায়। আবার রাত আসে। ময়নার সঙ্গে ঈশাতের গভীর মিতালি গড়ে ওঠে। একসময় ময়না কথা বলা শুরু করে। ঈশাতকে দেখলে ‘ঈ-শা-ত’ বলে ডাকতে পারে। ময়নার কণ্ঠে নিজের নাম শুনলে তার খুব ভালো লাগে। একদিন ঈশাত স্কুলের বন্ধুদের দেখাতে ময়না পাখিটি নিয়ে আসে। পাখির কণ্ঠে ঈশাতের নাম শুনে সবাই খুশি হয়। ঈশাতের বন্ধু বিজয়ও মুগ্ধ হয়। সে ময়নার দিকে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ঈশাত তা লক্ষ করে বলল, কিরে বিজয়, আমার ময়নার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছিস। মনে হচ্ছে ময়নার ঠিক প্রেমে পড়ে গেছিস! বিজয় গম্ভীর গলায় বলল, না, বন্ধু তোর পাখিটি খুব সুন্দর! রকিবের টিয়াপাখির চেয়ে আলাদা। কত মোলায়েম কণ্ঠে তোর নাম ধরে ডাকল! দেখতেও মাশাআল্লাহ।

-ধন্যবাদ, বিজয় সময় হলে আমাদের বাসায় আছিস। আমরা দুজন ওর সঙ্গে খেলব।

-আচ্ছা, ঠিক আছে। স্কুল ছুটি হলে ময়নাকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে ঈশাত। বাসা থেকে বাইরে কোথাও গেলে সব সময় ময়নাকে বারান্দা থেকে ঘরে নিয়ে যায়। কয়েকদিন পর ঈশাত তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কেনাকাটার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। কিন্তু ভুলবশত ময়নাকে বাসায় নেওয়া হয়নি। পথিমধ্যে তার মনে পড়ে। সে খুব চিন্তাগ্রস্ত হয়ে মনে মনে ভাবে, যদি হঠাৎ বৃষ্টি আসে, ময়না তো খাঁচার মধ্যে ভিজে অসুস্থ হয়ে যাবে। আবার অন্য কেউ যদি চুরি করে নিয়ে যায়! ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে বাবার কাছে বাসায় ফিরে যাওয়ার বায়না ধরে। বাবা তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাজারের দিকে নিয়ে আসেন। একসময় মন থেকে ময়নার টেনশন দূর হয়। ইচ্ছেমতো কেনাকাটা শেষ করে ওরা বাসায় ফিরে আসে। ঈশাত এক দৌড়ে ময়নার খাঁচার কাছে আসে। খাঁচাটি পড়ে আছে। কিন্তু খাঁচার মধ্যে ময়না নেই। খাঁচার দরজাটি খোলা। ময়নার কয়েকটি পালক নিচে পড়ে আছে। পালকগুলো হাতে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে। তার কান্নার আওয়াজে বাবা-মা বারান্দার দিকে ছুটে আসেন। মাহফুজ চৌধুরী ঈশাতের দিকে আগ্রহ ভরা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে, বাবা? এত কান্না করছ কেন?

ঈশাত কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, বাবা, বাজারে যাওয়ার সময় ময়নার খাঁচাটা বাসায় রেখে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন এসে দেখছি, আমার পাখিশূন্য খাঁচা পড়ে আছে। এই কথা বলে আবার ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে উঠল। বাবা-মা দুজনে তাকে সান্ত¡না দিলেন। কিন্তু ঈশাতের মন তা বোঝতে চায় না। সে তার প্রিয় ময়নাকে পেতে পাগলপারা। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে ঘরে নিয়ে আসা হলো।

এরই মধ্যে বাইরে জোরেশোরে বৃষ্টি নামল। বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে ঈশাত আবার ব্যালকুনির খাঁচার কাছে ফিরে এলো। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। না জানি কেউ আশপাশে তার প্রিয় ময়নাকে লুকিয়ে মজা করছে। কিন্তু কৈ? ময়নাকে তো দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া ও আমাকে দেখলে তো কিচিরমিচির শুরু করত। তবে কী...। ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে একসময় বাসার ছাদে এসে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে ছেলেকে বাসায় না পেয়ে বাবা-মা দুজনে খোঁজতে বের হলেন। অবশেষে তাকে বাসার ছাদে আবিষ্কার করলেন। ততক্ষণে ঈশাত ঠান্ডায় কাঁপছে। তাকে পাঁজাকোলা করে বাসায় নিয়ে আসা হলো। গায়ে প্রচ- জ্বর। মাহফুজ চৌধুরী তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে ডাক্তার নিয়ে এলেন। ডাক্তার ভালোভাবে দেখে ওষুধ দিয়ে চলে গেলেন। সাত দিন তাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। তারপর একটু ভালো বোধ করলে স্কুলের পড়া সংগ্রহের জন্য বিজয়দের বাসার দিকে এলো। বিজয় দূর থেকে তাকে আসতে দেখে দৌড়ে এগিয়ে আসে। তারপর সোজা তার পড়ার রুমের দিকে নিয়ে যায়। ঈশাত কুশলবিনিময় শেষে স্কুলের পড়া সব বুঝে নিচ্ছে। এমন সময় জানালা হয়ে তার চোখ যায় বারান্দার দিকে। বারান্দায় একটি খাঁচা ঝুলে আছে। খাঁচার মধ্যে একটি ছোট পাখি মনমরা অবস্থায় ঘাড় নিচু করে বসে আছে। পাখিটির গায়ের রং ধবধবে সাদা। ঈশাত ভাবতে লাগল, ঠিক আমার পাখিটার মতো দেখতে। শুধু রংটাই পার্থক্য। এরই মধ্যে বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিজয় ঈশাতের দিকে লক্ষ করে জানালাটা লাগিয়ে দিতে এগিয়ে এলে ঈশাত তা বারণ করে বলল, জানালাটা খোলা থাক না। ভালোই তো লাগছে। বাইরে থেকে হালকা বাতাস আসছে। তা ছাড়া তোর পাখিটিও খুব সুন্দর। বিজয় একটা ঢোক গিলে বলল, হ্যাঁ, পাখিটি আমার খুব পছন্দের। তোর ময়নার কী খবর? এখন আর কী কী বলতে পারে? ঈশাত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, নারে দোস্ত, আমার ময়না চুরি হয়ে গেছে। হঠাৎ করে বাইরে থেকে খাঁচার পাখিটি চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। বৃষ্টির মাত্রা খুব বেড়ে যাওয়ায় পাখিটি ভিজে একেবারে জবুথুবু হয়ে যায়। পাখিটির দিকে চোখ পড়তেই ‘ময়না! ময়না!’ বলতে বলতে বারান্দার দিকে ছুটে আসে ঈশাত। বিজয় খুব ভয় পেয়ে ঈশাতের পিছু পিছু আসে। এরই মধ্যে বিজয়ের মাও রান্নাঘর থেকে বারান্দায় ছুটে আসেন। বৃষ্টির জলে পাখির গায়ে সদ্য লেপে দেওয়া রং প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। পাখিটিকে দেখিয়ে ঈশাত বিজয়ের মাকে কাঁদো গলায় বলতে লাগল, খালাম্মা, এটা আমার পাখি। গত এক সপ্তাহ আগে আমাদের বাসার বারান্দা থেকে চুরি হয়েছে। বিজয়ের মা বিজয়ের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে বললেন, এই বিজয়, তুই না বললি এটি বনে পেয়েছিস? হ্যাঁ মা, আমি পাখিটি বনেই পেয়েছি। ও মিথ্যে বলছে। ঈশাত দুহাতে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, এই দেখুন, খালাম্মা, ও আমার পাখির গায়ে রং মেখেছে। বিজয় প্রতিবাদের সুরে বলল, আমি রং মেখেছি, সত্য। যাতে করে আমার পাখিকে অন্যের পাখিদের মধ্য থেকে সহজে আলাদা করে চিনতে পারি। ঈশাত একটু ভেবে নিয়ে খালাম্মাকে উদ্দেশ করে বলল, খালাম্মা, এটি যদি আমার পাখি হয়, তবে ওকে ময়না বলে ডাকলে ও আমার

নাম ধরে ডাকবে। তাহলে তুমি ওকে ময়না বলে ডাকো।

ঈশাত পাখিটির দিকে জলজল চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ময়না, আমার ময়না।’ সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার পাখিটি ডানা ঝাপটিয়ে বলল,

‘ঈ-শা-ত’ এতক্ষণে বিজয় ও বিজয়ের মা লজ্জায় মাথা নিচু করে

স্থির দাঁড়িয়ে রইল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist