শফিকুল ইসলাম শফিক
দাগ
সেদিনটা ছিল খুবই আশ্চর্য রকমের ভয়ংকর! স্কুলে ছিল কান্নার প্রতিধ্বনি। চারদিকে হাহাকার ধ্বনি তোলপাড় সৃষ্টি করে। হাহাকারে আকাশ-বাতাস ভারী ছিল। প্রতিদিন স্কুল সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা অবধি। এরপর স্কুলে বিকেল তিনটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা অবধি কোচিং করানো হয়। সেদিন নির্ধারিত সময়ে স্কুল ছুটির পর নির্ধারিত সময়ে কোচিং শেষ হলো।
স্কুলে কোচিং ছুটির পর যথারীতি স্কুলের প্রধান গেটে তালা লাগিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ সব ছাত্রছাত্রী চলে গেল। স্কুলের পেছনে একটি খেলার মাঠ আছে। কোচিং চলাকালীন সময়ে সাধারণত স্কুলের প্রধান গেট খোলা থাকে। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সেখানে খেলাধুলা করে। কোচিং ছুটি হলে আবার তারা বাড়ি চলে যায়। যাহোক, সেদিন দুটি শিশু স্কুলের মাঠে খেলা করছিল। গেটে তালা লাগাতে তারা কেউ বুঝতে পারেনি। দুজনেই আটকা পড়ল। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। প্রায় আধঘণ্টা শিশুদের কান্নার আওয়াজ। কিন্তু কেউই শুনতে পেল না। এমনকি স্কুলের আশপাশেও কোনো বাড়ি ছিল না।
কিছুক্ষণ পর একটি শিশুর মা তাকে স্কুলে খুঁজতে এলেন। শিশুদের কান্নার আওয়াজ কানে ভেসে এলো। তিনি ছটফট করতে লাগলেন। স্কুলের মাঠে যেতে চাইলেন। নাহ্। স্কুলের গেট তো খোলা নেই। স্কুলের চারদিকে প্রাচীর এবং প্রাচীরের মাথায় ভাঙা কাচখচিত করা। মা শিশুদের উদ্ধারের কোনো উপায় পাচ্ছেন না। মায়ের সাড়াশব্দে এক মুহূর্তে আরো অনেক শিশু সেখানে জড়ো হয়ে গেল। কিন্তু সবাই ছোট। বড় কারো হাতছাড়া শিশুদের উদ্ধার করা অসম্ভব। মা দিগবিদিক ছুটতে লাগলেন।
মারুফ ও রিয়াদ দুই বন্ধু। স্কুলের পাশ দিয়ে একটি চিকন গলি। তারা প্রতিদিন বিকেলে একটি মাঠে ক্রিকেট খেলে। সেদিন খেলা শেষে গলি দিয়ে বাড়ি ফিরতে ছিল। তারা একটু বড়, হাতও বেশ লম্বা। মা খুব অস্থিরবোধ করছেন। তাদেরক খুলে সবকিছু বললেন। শিশু দুটিকে উদ্ধারের আদেশ দিলেন। মারুফ সাহসী ছেলে। দয়াপরবশ হলো। মায়ের এমন আবদার ফেলতে পারল না।
অতঃপর দুই বন্ধু মিলে স্কুলের প্রাচীর টপকে শিশুদের উদ্ধার করতে মনস্থ করল। যেই ভাবা, সেই কাজ। প্রাচীরের একপাশে লাগোয়া একটি উঁচু ঢিবি ছিল। শিশুদের উদ্ধার করতে তারা সেখানে দাঁড়িয়ে অনেক চেষ্টা অতিক্রম করল। প্রথমে রিয়াদ লম্বা হাত মেলিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই একটি শিশুকে উদ্ধার করে। এরপর মারুফ আরেক শিশুকে উদ্ধার করতে গিয়ে মস্ত বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়। লাফ দিয়ে নামার সময় তার বাম হাত প্রাচীরের কাচে লাগল। হাত দিয়ে ভীষণ রক্ত ঝরছে। শিশুটির মা শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে মারুফের হাত বেঁধে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
মারুফের মা-বাবা ছেলেকে দেখে নিমিষেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাদের সাড়াশব্দে বাড়িতে পাড়ার অনেকেই ছুটে এলো। তার মা বাঁধন খুলে দেখলেন, ছেলেটির হাত অনেকখানি কেটে গেছে। বাবা ভাবলেন, বাড়িতে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। শিগগিরই ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার অবশ করে তার হাতে দুটি সেলাই দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। বিভিন্ন ওষুধপত্র লিখে দিলেন।
এরপর ওষুধপত্র কিনে ছেলেকে বাড়ি নিয়ে এলেন। মারুফের এখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ। পরদিন সকালে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ সব ছাত্রছাত্রী মারুফকে দেখতে এলো। মারুফের মনে হয়, স্কুলের সবাই আমাকে এত ভালোবাসে! তার হাতে যেন আজ কোনো ব্যথা নেই। হাসিমুখে সবার সঙ্গে অনেক কথা বলে। সবাই তার জন্য প্রার্থনা করে। মা-বাবার অতি যত্নে ছেলেটি শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠল। এখন নিয়মিত স্কুলে যায়। বাম হাতের কাটা দাগ মেশেনি। হয়তো চিরদিন এই দাগ থেকে যাবে। সে ভাবে-দাগে কী যায় আসে? দাগের চেয়ে সেদিনের শিশু দুটির জীবনই বড়।
"