শরীফ সাথী
শীর্ষ ও রাখাল দল
নাতি দাদুকে বলল, দাদু ভাই সানকে ঘাট কাকে বলে? দাদু মুচকি হেসে বলল, দুষ্টু নাতি সানকে ঘাটও চেন না। এই আমরা আজ নদীর তীরে সান বাঁধানো ঘাটের ওপরে বাঁশের মাচায় বসে রয়েছি। ওই যে নিচের সান বাঁধানো ঘাটটিই সানকে ঘাট। এ ঘাটের পানিতে যতদূর নামবে বালি আর শুধু বালি, একটুও কাদা নেই। বড্ড আরামে গোসল হয় মানুষজন গরু-মহিষের এখানে। টলোমলো ছলোছলো ঝলমলে ঝরনা মাখা জল কোমরপুর গ্রামের এই ঘাটটি প্রাচীন আমল থেকে সানকে ঘাট হিসেবে পরিচিত। নাতি বলল, দাদু তাহলে আজকে বৈকালী হাওয়ায় এমন একটি গল্প শোনাও যেখানে নদীতীরে মায়াবী পরিবেশে রাখাল বাঁশি সুর তোলে? দাদু বলল, শোন নাতি ভাই, আমার চোখে দেখা একটি বাস্তবতার গল্প তোকে বলে শোনাই।
প্রকৃতির নান্দনিক ছন্দনিক গাঁথুনিতে গাঁথা পাটাচোরার তীরধরা দ্বীপ। মাথাভাঙ্গা ও ভৈরব নদীর জলে ঘেরা দ্বীপটি সবুজ অরণ্যের শ্যামল হাসি মুখে, সুখে মুখরিত করে তার বুকে। নিদারুণ অনুভূতিময় বৈচিত্র্যময় দ্বীপটির মায়াময় ছায়া। পাখিদের কুঞ্জনে গুঞ্জনে বিভোর। ঘাসফড়িংয়ের লাফালাফির দৃশ্য নদীর তীরের অপরূপ চাওয়া হীমেল হাওয়ায় একাকার। মাঝি দলের নৌকা বেয়ে অবিরত চলা। রাখাল দলের মিলনমেলা নিত্য ব্যাপার। পাটাচোরা সুবুলপুর রঘুনাথপুর কাঞ্চনতলাসহ বেশ কিছু গ্রামের রাখাল বালকের গরু ছাগলের চরানোর দৃশ্য নদীর তীরঘেঁষা এই তীরধরা দ্বীপে। প্রতিদিনের প্রতিনিয়ত বাঁশির সুর তোলা, হরেক রকম খেলায় সাজানো প্রকৃতির ভালোলাগার অনুভব। কয়েক গ্রামের কচি কচি কোমলমতি শিশুদের পড়ালেখা করতে যেতে হয় এই তীরধরার তীর বেয়ে নদীর তীরবর্তী স্কুল পাটাচোরায়। যাওয়া-আসার ফাঁকে ফাঁকে সময় করে রাখাল বালকদের সঙ্গে বিভিন্ন খেলায় মেতে ওঠে। লাটিম ঘুরানো, গুটিখেলা, বলখেলা, গাদিখেলা, ডাংগুলি, নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি। হরেক খেলনার পরশার মাঝে একটি খেলা নয়ন কাড়ে। চিতেগাছ কেটে তা হাত এবং পায়ের সাহায্যে টেনে পাইপের মতো করে নল বানিয়ে, চার-পাঁচটা নল একসঙ্গে জোড়া দিয়ে এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পানি ওই পাইপ দিয়ে যাতায়াতের দৃশ্যগুলো মনে করে দিল স্মৃতির মেমোরি। পাটাচোরা গ্রামের ছোট্ট ছেলে শীর্ষ। তার খুব ইচ্ছে করে রাখাল বালকদের সঙ্গে খেলতে। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যতায় চায় তার সোনালি স্বপ্ন মাতামাতি করতে। তিন-চারজন সঙ্গী নিয়ে স্কুল ফাঁকি দিয়ে রাখাল বালকদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে খেলা করে স্কুল সময় অতিবাহিত করে। এভাবে মাস পেরুতেই স্কুলের শিক্ষকরা শীর্ষর বাবা-মায়ের কাছে অভিযোগ করে বলল, ছেলে ঠিকমতো স্কুলে আসছে না কেন? শিক্ষকের এমন কথায় বাবা-মা তো হতবাক। কেন ছেলে তো নিয়মিতই স্কুলে যায়? সন্ধ্যার পর, পড়ার টেবিলে বাবা-মা হাজির হয়ে ছেলেকে বলল, তুমি স্কুলে না গিয়ে কোথায় যাও? শীর্ষ স্তম্ভিত হয়ে গেল। নির্বাক চাহনী। প্রশ্নের উত্তর নেই তার মুখে। মা আচ্ছামতো বকাঝকা করে চলে গেল। বাবা ছেলেকে অভয় দিয়ে বলল, কী হলো বলো, কোথায় যাও স্কুলের সময়? শীর্ষ অভয় আশ্বাস পাওয়ায় লুকানো মুখ সহজ করে বলল, তীরধরা দ্বীপে রাখাল দলের সঙ্গে খেলতে যায়। তার কল্পনাময় স্বপ্নলোকের অনুরাগের কথাগুলো বাবাকে খুলে বলল। বাবা রাগান্বিত হলেও হাসতে হাসতে বলল, খেলাধুলা খেলবে তাতে তো আপত্তি নেই। কিন্তু স্কুল ফাঁকি দিয়ে খেললে হবে? আমাদের অনেক স্বপ্ন তুমি পড়ালেখা করবে। অনেক বড় হবে। মানুষের মতো মানুষ হবে। মুখ উজ্জ্বল করবে। গরিব অনাথ রাখাল ছেলেগুলো কারো বাবা নেই আবার হয়তো কারো মা নেই। গেরস্থালির বাড়ির গরু চরানো দুঃখ-কষ্ট গাঁথা কোমলমতি রাখাল ছেলেগুলোর প্রতি আমারও খুব মায়া হয়, দরদ হয়। কিন্তু কী করার আছে বল বাবা? তুমি যদি আমার উপদেশমতো চলতে পারো, তাহলে আমার, তোমার এবং রাখাল ছেলেগুলোর বড্ড উপকার হবে। কেউ তোমার জন্য আর কমপ্লেন (অভিযোগ) দেবে না? সবাই ভালো ছেলে বলবে। শীর্ষ তার বাবার মুখের দিকে চেয়ে বলল, কী উপদেশ বলো না খুব শুনতে ইচ্ছে করছে? বাবা বলল, তুমি সময়মতো স্কুলে যাবে। স্কুলের লেখাপড়া মনোযোগ সহকারে করবে। ছুটি শেষে বাড়ি এসে বিকেলবেলা ওদের সঙ্গে খেলতে যাবে। সঙ্গে করে নিয়ে যাবে মুড়ি আর খেজুর গুড়ের ছিন্নি (পাটালি)। আরেকটা জিনিস ও নেবে সঙ্গে? শীর্ষ বলল, কী জিনিস? বাবা বলল, ওদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য বই-খাতা। আচ্ছামতো গ্রামীণ খেলাধুলা শেষে দল বেঁধে পাটালি দিয়ে মুড়ি খেয়ে একেক দিন বইয়ের অক্ষর শেখাবে, যা পরদিন খেলতে খেলতেই ওরা বলবে, দেখবে? কারণ মনে রাখার জন্য ওরা রাতে ওই পড়াগুলো চর্চা করবেই। শীর্ষ হাসতে হাসতে বলল, লক্ষ্মী বাবা আমার তাই হবে। সুন্দর মায়া ছায়ার পরিবেশবান্ধব তীরধরা দ্বীপে চলতে লাগল শীর্ষ ও রাখাল ছেলেগুলোর অন্য রকম জীবন। যেখানে সুর ছন্দ-আনন্দ অফুরান। এমন সময় নাতি বলল, খুব ভালো লাগল দাদু ভাই? দাদু বলল, চল নাতি ভাই, সন্ধ্যা হলো পড়তে বসবে?
"