বাসুদেব খাস্তগীর

  ২৩ জুন, ২০১৮

গল্প

বাবার স্বপ্ন

সুমনা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা ঢাকায় ছোট একটি চাকরি করেন। মা গৃহিণী। বাবার সামান্য আয়ে সংসার চলে। ছোট্ট একটি কক্ষ ভাড়া করেই ঢাকায় ওদের বসবাস। উদ্দেশ্য মেয়ের পড়াশোনা। সুমনার বাবা দরিদ্রতার কারণে বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। অভাব-অনটনের জন্য অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। জীবনে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে সুমনার বাবা অনেক কিছুই শিখেছেন। মনের মধ্যে যে বিষয়টা তাকে সব সময় নাড়া দেয়, সেটা হলো বেশি পড়ালেখা করতে না পারা। সে আক্ষেপ সব সময় তাকে তাড়িত করে বেড়ায়। এসএসসি পাস করেই জীবন সংগ্রামে তাকে যুদ্ধে নামতে হয়েছে। সুমনার বাবা মনে করেন আর একটু বেশি পড়ালেখা থাকলে চাকরিতে সে অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু অল্প পড়ালেখার কারণেই তাকে আজ ছোট্ট চাকরিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। অথচ পড়ালেখায় তো কম মেধাবীও ছিলেন না। যা হোক, এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে তিনি মেয়েকে পড়ালেখা শিখিয়ে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। মেয়ের পড়ালেখার ব্যাপারে তিনি যেকোনো ত্যাগ স্বীকারেও প্রস্তুত। তার স্ত্রীও মেয়ের পড়ালেখার ব্যাপারে অত্যন্ত যতœবান ও সচেতন। স্ত্রীও এসএসসি পাস। সুমনার এখন বয়স ছয়। লিখতে পারে, পড়তে পারে। অক্ষর জ্ঞান, পড়তে শেখা সবকিছুই মায়ের কাছে ঘরে বসেই। ছটপট দুরন্ত এক মেয়ে। সুন্দর সুন্দর কথা বলে। বড়ই আদূরে। মা-ই সুমনার প্রথম পাঠশালা। গত মাস তিনেক আগে সুমনাকে বাবা-মা পাশের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছে। বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু টাকাপয়সা বেশি লাগবে বিধায় ভর্তি করা হয়নি, যা হোক সুমনা এখন প্রতিদিন স্কুলে যায়। বাবা সকালেই চাকরিতে যাওয়ার পর মা-ই সুমনাকে বিদ্যালয়ে দিয়ে আসেন। আবার বিকেল হলে আনতে যান। ইদানীং বাবা লক্ষ করছেন সুমনার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন। তার চালচলন ও কথাবার্তাতে অনেক পরিবর্তন। লেখাপড়ার পাশাপাশি যে অনেক কিছুই শেখার আছে, তা সুমনার মধ্যে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। একদিন সুমনা বাসায় এসে মাকে বলে, ‘মা আমার স্কুলের বন্ধুরা না খুব ভালো’। মা বলেন, ‘তোমাকে ভালোবাসে?’ হ্যাঁ। উত্তর দেয় সুমনা। মা বলেন, ‘আর শিক্ষকরা?’ শিক্ষকরা আমাকে খুব আদর করে। আধো আধো গলায় সুমনা উত্তর দেয়।

আগে বাড়িতে দুরন্তপনা করে যে সময় কাটাত তা অনেকটা কমে গিয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকে সুমনা। কারণ বিদ্যালয়ে স্যার বলেছেন বড় হতে হলে পড়াশোনা করতে হবে। বিদ্যালয়ে স্যারের কথাবার্তা শোনায় তাকে বেশ মনোযোগী মনে হয়। সুমনার বাবা একদিন সুমনা কে বলেন, মা স্কুল কেমন লাগছে? সুমনা বলে, বাবা জানো গতকাল ক্লাসে শিক্ষক বলেছেন, আমাদের স্কুল আনন্দের এক রঙিন ফুল।

বাবা বলেন, ‘বেশ চমৎকার বলেছে তো’।

তুমি তো মা স্কুলেই অনেক কিছুই শিখছো, আমরা এখন তোমার থেকে শিখবো, তুমি স্কুলে যা শিখছো, তা আমাদের বলবে, আমরা শিখে নেব, বাবা এ কথা বলতেই সুমনার মুখে একগাল হাসি। এ হাসির যেন তুলনাই হয় না। আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটি। সুমনার মা-বাবা ঠিক করেছেন আজ সুমনাকে রমনা পার্কে নিয়ে বেড়াতে যাবেন। বিকেলে বের হলেন সুমনাকে নিয়ে, উদ্দেশ্য পার্ক দেখা এবং একটু বেড়ানো। বিকেল পাঁচটার দিকে পার্কে উপস্থিত। গাছ, গাছের ছায়া, মাঝে বসার ব্যবস্থা দেখে সুমনার ভালোই লাগছে। পার্কে অনেক লোক ঘোরাঘুরি করছে, গল্প করছে। এই প্রথম সে পার্কে এসেছে, আগে সে গ্রামে ছিল। কখনো তার পার্ক দেখা হয়নি।

চারদিকে ঘুরে দেখছে আর এটাসেটা প্রশ্ন করছে। মা-বাবা যতটুকু পারছে, তা উত্তর দিচ্ছে। কতক্ষণ হাঁটার পর তারা বিশ্রামের একটা জায়গায় বসলেন। এমন সময় এক বাদামওয়ালা হাজির। বলে, ‘স্যার বাদাম দেবো’?

সুমনা বলে, ‘বাদাম খাবো বাবা, বাদাম নাও’। সুমনার বাবা বলেন, ঠিক আছে। বাদাম ওয়ালাকে বলে, ‘দাও দশ টাকার বাদাম দাও’।

বাদাম নিয়ে সবাই খাচ্ছে। আর খোসাগুলো নিচে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু বাবা লক্ষ করলেন, সুমনা এক জায়গায় খোসাগুলো জড়ো করছে। সুমনা বলে, ‘বাবা খোসাগুলো নিচে ফেলো না, এগুলো একসঙ্গে কাগজে করে ওই যে ডাস্টবিন সেখানে রেখে আসব।’ সুমনা ইতোমধ্যে ফেলা খোসাগুলো কুড়িয়ে নিল এবং কাগজে করে নিয়ে দৌড়ে ডাস্টবিনেই রেখে এলো। সুমনা বলে, ‘স্যার বলেছেন ময়লা যেখানে-সেখানে ফেলতে নেই, ময়লা ফেলতে হয় ডাস্টবিনে। তাই ময়লাগুলো ডাস্টবিনেই ফেলেছি বাবা।’ সুমনার বাবা সুমনার কথা শুনে অবাক, আর গর্বে বুকও ভরে গেল। বাবা বলেন, ‘জানি মা কিন্তু আমরা অনেকে জেনেও তা মানি না। এ জন্যই বলি, তুমি আমাদের শেখাবে মা।’ বলতেই সুমনা মুখে আবার সেই গালভরা হাসি। বাবা ভাবে মেয়ে তো অনেক কিছুই শিখছে স্কুলে। শিক্ষকের কথাকে সে মনে ধারণ করছে। একজন শিক্ষক একজন শিশুর মনে যেভাবে রেখাপাত করেন আর কেউ হয়েতো সেভাবে পারে না। এ জন্যই তো একজন শিক্ষক হন সবার আদর্শ। সুমনার বাবা আরো ভাবেন, পার্কে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা। সবাই একটু সচেতন হলেই আমরা আমাদের এই পার্ককে, পরিবেশকে কত সুন্দর রাখতে পারি। মেয়ের কথা ভেবে তার অহংকার হলো। আদর করে মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন এবং বাসার দিকে রওনা দিলেন। সুমনার বাবা যেতে যেতে ভাবেন সুমনা শিক্ষকের স্বপ্ন যেভাবে মনে ধারণ করছেন, বাবার স্বপ্নও এক দিন হয়তো বাস্তবে রূপায়িত করবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist