মো. মেহেদী হাসান

  ০২ জুন, ২০১৮

মানব রোবট

দশম শ্রেণির ছাত্র তন্ময়। বাবা সরকারি চাকরিজীবী। অফিসের কাজে দেশের বিভিন্ন স্থানে বদলি হতে হয়। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে তার। মানব রোবট হিসেবে তার নামটা বেশ খ্যাতি অর্জন করে নিয়েছে বন্ধুদের মধ্যে। এ নাম ধরে ডাকার বিশেষ একটি উদ্দেশ্য আছে বন্ধুদের কাছে। রুটিন অনুযায়ী চলতে চলতে তন্ময় সত্যিই মানব রোবটে পরিণত হয়েছে। বাবা খুব কঠোর মনের মানুষ। বাবা কথার নড়চড় করেন না। এক কথা একবারই বলেন। শেষ বদলির পর এবার পরিবারসহ এসেছে রাজশাহীতে। বাবার বয়স হয়েছে। এখন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাগটা মোটামুটি কমেছে বললেই চলে। বাবার ক্ষেত্রে এটা ঠিক উল্টো হয়ে গেছে। কারণ একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর সব মানুষের মধ্যেই ইনস্যানিটি (পাগলামো ভাব) কাজ করে। কারো কম, কারো আবার বেশি।

ঠিক মনে পড়ছে না দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ছেলে স্কুলে। বাবা অফিসে। মা বাড়িতে একা। কাজের মেয়ে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে। মায়ের একা একা সময় কাটে না। অনেক দিন গ্রামে যাওয়া হয়নি এ কথা মনে মনে ভাবতে ভাবতেই তন্ময়ের প্রবেশ। মা বলল, ‘হাত-মুখ ধুয়ে আই আমি নাশতা দিচ্ছি।’ সে অগোছালো একজন ছেলে। নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা কি জিনিস সে এখনো জানে না। মায়ের কড়া নজরদারি এবং বাবার কড়া শাসনে তার বড় হয়ে ওঠা। স্কুল বাদে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হতো না তাকে। সব সময় মনমরা হয়ে ঘরে বসে থাকত। মাঝেমধ্যে শখ জাগে যদি আমার একটা সাইকেল থাকত। যদি বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি উড়াতে পারতাম, কয়েকটা ভালো বন্ধু থাকত, যাদের কাছে মনের কথাগুলো ভাগাভাগি করতে পারতাম। স্বপ্নগুলো তার স্বপ্ন হয়ে থেকে যায়। হঠাৎ তার মাথায় চিন্তা আসে বাবা আজ বাড়িতে এলে বলবে, ‘বাবা আমার এ রকম জীবন ভালো লাগে না। আমি চাই আমারও বন্ধু হোক। আমিও বিকেলবেলা খেলার মাঠে গিয়ে খেলতে চাই।’ বাবা আসার আগেই সে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে নিল কথাগুলো বলা যাবে কি না? মায়ের তেমন উত্তর পাওয়া গেল না। মা বলল, ‘দেখ বাবা আমরা যা করি তা তো তোর ভালোর জন্যই।’ সে ছাপ ছাপ বলে দিল বাবাকে আজ কথাগুলো বলে মন হালকা করে নেবে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম, খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বাবার বাড়িতে প্রবেশ। হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে কথা। খাবার খাওয়া শুরু করতে না করতেই তন্ময় বলে উঠল, ‘বাবা আমার কিছু কথা ছিল?’ বাবা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘যা কথা খাওয়ার পর বলবে।’ খাওয়া শেষ বাবা শোবার ঘরের দিকে গেল। তন্ময়ও বাবার পিছু নিল। এবার বাবাকে বললাম, ‘বাবা বাড়িতে আমার একা একা ভালো লাগে না, কিছু সময় আমি বন্ধুদের সঙ্গে কাটাতে চাই।’ বাবা খাটের ওপর পা তুলে বসল। মুখে কেমন একটা চিন্তার ছাপ প্রকাশ পাচ্ছে। অনেকক্ষণ চিন্তার পর বাবার উত্তরÑ‘বাড়িতে তোমার খেলার জন্য যথেষ্ট উপকরণ আছে। বিনোদনের জন্য বাড়িতে টেলিভিশন, মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ভিডিও গেম আছে, মন চাইলে তুমি সেগুলো ব্যবহার করো।’ বাবার উত্তরে তন্ময় সম্মতি দিল না। সে বলল, ‘আমিও তো মানুষ, আমারও কিছু দাবি-দাওয়া থাকতে পারে। রোবটের মতো বাড়িতে বসে থেকে আমি ক্লান্ত। ‘আচ্ছা তোমার কথা আমি ভেবে দেখব’Ñউত্তর দিল বাবা। রাতে মায়ের সঙ্গে বাবার আলাপন চলছে, ‘ছেলেকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাওয়া উচিত।’ সে একা একা বাড়িতে বসে বসে মনমরা হয়ে গেছে। বাবা মাকে বলল, সামনে শীতকালীন ছুটিতে তন্ময়কে নিয়ে তার নানার বাসায় যাব। দেখতে দেখতে শীতকালীন ছুটি চলে এলো। টানা পনেরো দিনের ছুটি। তন্ময়কে তার বাবা বলল, ‘কিছুদিনের জন্য আমরা তোমার নানার বাসায় যাব।’ তন্ময় কথাটি শুনে খুশিতে নেচে উঠল। অনেক দিন নানার বাড়ি যাওয়া হয়নি, এবার ছুটিতে সেই সুযোগ পাওয়া গেছে। সুযোগটা হাতছাড়া করা যাবে না। সে একটু বেশিই কৌতূহলী হয়ে উঠল। আর দুই দিন পর ভ্রমণ শুরুর পালা। সময় যে আর কাটে না, ঘড়ির কাঁটার গতি যেন মন্থর হয়ে যাচ্ছে। তন্ময় মনে মনে ভাবছে আর আক্ষেপে ভেঙে পড়ছে। দুই দিন পর নানার বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ার কথা। রাতে চিন্তার কারণে ঘুমাতে পারেনি। তাই সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই বাবার বকুনি খেতে হলো তাকে। বাবাকে কিছু বলা গেল না, চুপচাপ বাবার সঙ্গে চলল সে। তার একটা ভুলের জন্য সকাল ৮টার প্রথম বাস ধরতে পারেনি তারা। তাদের গন্তব্য জয়কৃষ্ণপুর। বগুড়া জেলার জয়দেবপুর থানার একটি গ্রাম। গ্রামটি উন্নয়নের ছোঁয়া পাইনি বললেই চলে। এখনো মানুষ মাটির রাস্তা দিয়েই চলাফেরা করে। বর্ষাকালে রাস্তাঘাট কাদা আর পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। ফসলি জমির প্রতিটি কোনা পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। প্রথম বাস ধরতে না পারায় দ্বিতীয় বাসে করেই শহর থেকে রওনা দিল তারা। বাসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও এবারের অভিজ্ঞতা ঠিক ভিন্নতর। এত সকালে তারা কখনো বাসে যাত্রা করেনি। তন্ময় ও তার মা বসল একসাথে আর তার বাবা বসল অন্য এক ছিটে। ‘শীতের সকাল’ কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারদিক। বাসের জানালা সবগুলো বন্ধ। বাসের বাইরে অল্প অল্প দেখা যাচ্ছিল। তন্ময় জানালার পাশে বসল, হঠাৎ একদল জেলেকে দেখতে পেল সে। তারা তাদের মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে নদীতে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। পাশের ফসলি জমিতে কৃষকরা চাষের কাজ করছে। চারদিকের মনোরম পরিবেশ তাকে মুগ্ধ করে তুলেছিল। দেখতে দেখতেই দুঘণ্টা কেটে গেল। বাস পৌঁছাল বগুড়া শহরে। শহর থেকে কিছুটা পথ যাওয়া হলো ভ্যানগাড়িতে। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ, বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। যেন এক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ভ্যান থেকে নামার পর নৌকা দিয়ে নদীপারের পালা। তন্ময় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। এই প্রথম তার নৌকায় চড়া। মাঝি দাড় বাইছে আর গান গাইছে। তার সুরে লোকসংগীত খুব শ্রুতিমধুর শোনাচ্ছিল। নদীর একপাশ থেকে অন্যপাশে গেল তারা তিনজন। ভাড়া পনেরো টাকা। প্রতিক্ষার পালা শেষ হতে চলেছে। নদী থেকে কিছুদূর হাঁটার পর নানার বাড়িতে পৌঁছে গেল তন্ময়। হঠাৎ বাড়িতে প্রবেশ সবাইকে চমকপ্রদ করে তুলল। নানি তন্ময়কে দেখে খুব খুশি হলো। প্রায় দুই বছর পর এখানে বেড়াতে আসা তাদের। আনন্দে নানি একদম কেঁদেই ফেলল। তন্ময়কে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুই এসেছিস তন্ময়’ আমি খুব খুশি হয়েছি। হাত-মুখ ধোয়ার জন্য সবাই গেল পুকুরে। মামা, মামি দেখা করতে আসল। মামা তন্ময়কে খুব ভালোবাসে। মামার একমাত্র আদরের ভাগনে। সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ, এবার তন্ময়ের ঘুরতে বেরোনোর পালা। দুপুরবেলা আকস্মিকভাবে গোসল হলো নদীতে। মামাতো ভাই প্রিতমের সঙ্গে গোসল করল সে। প্রিতম ক্লাস এইটে পড়ে। পড়াশোনায় খুব একটা ভালো না হলেও আচার-আচারণ খুব সৌহার্দ্যপূর্ণ। বিকেলবেলা তার সঙ্গেই ঘুরতে যাওয়া হলো। গ্রামের প্রকৃতি তন্ময়ের খুব মনে ধরেছে। কোলাহলমুক্ত সবুজ এই প্রকৃতি তার মনকে মলিন করে দিয়েছ। বিকেলবেলা সব ছেলেমেয়ে তাদের গবাদি পশু যেমন : গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ এই পশুগুলোকে মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে আসে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঘুড়ি উড়ানোর কাজে ব্যস্ত। গরু ও ছাগলরা ঘাস, লতা, পাতা খায় আর ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ খেলা খেলে। কেউ খেলে কানামাছি, কেউ আবার পুতুল। তন্ময় এগুলো মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে আর ভাবতে থাকে, আমি যদি এ রকম হতে পারতাম। প্রিতম তন্ময়কে বলল, ‘এগুলো আমাদের রীতি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। গ্রামের জীবনটাই এ রকম। নেই কোনো কোলাহল, নেই যানজট, নেই গাড়ির শব্দ। আছে পাখির কিচিরমিচির, সবুজ গাছ, মন ঠা-া করার মতো বাতাস।’ দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে গেল, সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ল। ছেলেমেয়েরা তাদের গরু, ছাগলকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল। সঙ্গে সঙ্গে তন্ময় ও প্রিতম বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল। সন্ধ্যা নামার পর রাতের খাওয়া সেরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে তন্ময়ের আর ঘুম আসে না। সে ভাবতে থাকে কখন সকাল হবে, সে খেজুর রস খাবে। কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর মুরগির ডাক শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে তন্ময় তার মামার সঙ্গে জেগে উঠল। আজ সে খেজুরগাছের রস আনতে যাবে। চারদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন, দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। শীতের পোশাক পরে মামার সঙ্গে বের হলো। মামা এবার খেজুরগাছ থেকে রস নামিয়ে নিয়ে এলো। রস নামানো শেষ, বাড়িতে গিয়ে দেখে নানি এদিকে ভাপা পিঠা তৈরি করছে। হাত-মুখ ধুয়ে ভাপা পিঠা নিয়ে বসে পড়ল সবাই। পিঠা খাওয়া শেষ করে মুড়ি আর রস নিয়ে বসে পড়ল সে। সবকিছু কেমন কল্পনার মতো মনে হতে থাকে তার। এভাবে চলতে চলতে ছয় দিন শেষ। আজ বিদায়ের পালা। যেতে ইচ্ছা করছে না। তবু যেতেই হবে। সবার কাছে বিদায় নিয়ে শহরের উদ্দেশে বের হলো তন্ময়ের পরিবার। যাওয়ার সময় প্রিতম খুব কান্নাকাটি করছিল। তন্ময়েরও মন খারাপ, সবার মায়া ত্যাগ করে বিদায় নিল তারা।

সব স্মৃতি মাথায় নিয়ে তারা রওনা দিল। তারা সবাই এখন শহরে, আবার রোবটের মতো রুটিন শুরু। সে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। বাবা-মায়ের একটাই আশা, এবার ছেলে জিপিএ ফাইভ পাবে। বাবা-মায়ের কথা রাখার জন্য তন্ময়ের কার্যক্রম শুরু। তবে এর মধ্যে একটি শর্ত আছে, সে যদি এবার পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাই তাহলে তাকে একটি ভালো ক্যামেরা কিনে দিতে হবে। বাবা তার শর্তে রাজি। রীতিমতো ফেব্রুয়ারি মাসে পরীক্ষা হলো এবং তন্ময় জিপিএ ফাইভ পেল। তার কথা অনুসারে বাবা তাকে ক্যামেরা কিনে দিল। একে একে তার স্বপ্নপূরণ হচ্ছে। সে এখন খুব খুশি, খুব আনন্দের সঙ্গেই কাটে তার চলতি জীবন। এমন সময় সে বাংলাদেশের খ্যাতিমান রাজশাহী কলেজে ভর্তি হয়। এখন সে রাজশাহী কলেজের ছাত্র। তারও এখন অনেক বন্ধু হয়েছে। তাদের মধ্যে তৃষ্ণা, মারুফ, কুমকুম, মহিদুল তার ভালো বন্ধু। নিয়ম অনুযায়ী পড়াশোনা চললেও আড্ডার কোনো কমতি নেই তাদের। কলেজে টিচারদের কাছে সে নয়নের মণি। তন্ময়ের আর কোনো সমস্যা নেই, সে এখন আর খাঁচায় বন্দি পাখির মতো না। সে এখন মুক্ত। নিজের মন যা বলে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারে। বাবা তন্ময়কে আর কিছু বলে না। বাবা বলে, ছেলে বড় হয়েছে, তারও কিছু স্বাধীনতা প্রয়োজন। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে জীবন কাটাতে পারাই তন্ময় খুব আনন্দিত। সব আনন্দের পরও তার নানির বাড়ি বেড়ানোর ঘটনাগুলো তার মন কাড়ে। এ রকম বিস্ময়কর ভ্রমণের জন্য বাবাকে ও মাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার কলেজ জীবনের পড়াশোনা চিন্তামুক্তভাবে চালিয়ে যায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist