মোহাম্মদ অংকন
শুভ ও পাখি
সকালবেলা। বৃষ্টি পড়া একদম থেমে গেছে। শুভ এবং ওর আম্মু বারান্দায় বসে আছে। এমন সময় বৃষ্টিভেজা একটা পাখির ছানা তাদের বারান্দায় এসে মুখ থুবড়ে পড়ল। শুভ পাখিটার নামটা কী, তা নির্ণয় করতে পারল না। ওর আম্মু এগিয়ে পাখির ছানাটিকে হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘ইশ! পাখিটি আমাদের চোখের সামনে না পড়লে হয়তো কুকুর-বিড়াল ধরে খেয়ে ফেলত। বৃষ্টিতে ভিজে একদম দুর্বল হয়ে গিয়েছে।’ তারপর শুভ পাখিটির শরীর কাপড় দিয়ে ভালো করে মুছে দিল। পাখিটাকে কিছু শস্যদানা খাওয়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই খেল না। ঝড়ের তান্ডবে ভীষণ ভয় পেয়েছে। তার হৃৎপিন্ডটা ক্রমশ কাঁপছে। তারপর একটি টোপার নিচে ওকে আটকে রাখল এই ভেবে যে, সস্থ হলে ছেড়ে দেবে।
কিন্তু শুভ তার কথা রাখতে পারল না। কেননা, পাখিটাকে তার ভীষণ ভালো লাগল। শরীর থেকে যতই পানি শুকিয়ে যাচ্ছিল, ততই পাখিটির পালকগুলো উজ্জ্বল হচ্ছিল। আর পাখিটিকে ততই চমকপ্রদ লাগছিল। বিকেলবেলা শুভ সাইকেল চালিয়ে খাঁচা কিনতে বাজারে ছুটে গেল। ৫৩০ টাকা দিয়ে সুন্দর একটা খাঁচা কিনে আনল। পাখিটিকে খাঁচায় ভর্তি করল। পাখিটি নড়াচড়া করতে লাগল। শুভ তার বন্ধুদের ডেকে এনে সুন্দর এ পাখিটিকে দেখাল এবং বলল, ‘তোমরা কি কেউ এই পাখিটির নাম জানো?’ কিন্তু কেউই পাখিটির নাম বলতে পারল না। সবাই শুধু ‘খুব সুন্দর’ বলে প্রশংসা করল। কেউ আবার আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, ‘কোথায় পেলে পাখিটি? কিনলে নাকি?’ শুভ তাদের ঘটনাটা বলল।
বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গেল। পাখিটি ধীরে ধীরে খাঁচায় পোষ মেনে গেল। কিন্তু বন্দিজীবন সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। বিষয়টি শুভর বুঝতে একদমই দেরি হলো না। মাঝে মাঝে পাখিটি খাঁচায় মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়াত। শুভকে দেখলেই পাখিটার কেমন যেন অস্থিরতা বেড়ে যেত। ওড়াউড়ি করত। যেন তার শরীরের সব শক্তি দিয়ে খাঁচাটি ভেঙে আকাশে উড়ে যাবে। কিন্তু সে কোনো মতেই পারছে না তা করতে। তারপর পাখিটিকে বন্দি করে রাখা শুভর দ্বারা সম্ভব হলো না। শুভ কোনো দিন পাখি পোষেনি। হয়তো এবারও না হয় পুষবে না। এমনই সাত-পাঁচ ভেবে পাখিটির প্রতি তার ভীষণ মায়া হলো। পরের দিন সকালে পাখিটিকে খাঁচা হতে ছেড়ে দিল। সে উড়ে গিয়ে শুভদের বাড়ির দক্ষিণ পাশের ঝুপড়ি জলপাই গাছের ডালে বসল। শুভ শুধু চেয়ে থাকল। তার কাছে কেমন যেন মনে হলো পাখিটিও শুভর দিকে তাকিয়ে রয়েছে আর লেজ নাড়ছে।
আরো কয়েকটি দিন চলে গেল। পাখিটির কথা শুভ ভুলে যায়। কিন্তু একদিন দুপুরে একটি সুর তাকে ওই পাখির কথা মনে করিয়ে দেয়। তখন তার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চলছিল। ঘরে বসে অঙ্ক করছিল। হঠাৎ তার কানে আসল, মধুর সুরে একটি পাখি ডাকছে। শুভ বাইরে বের হতেই জলপাই গাছের ডালে কয়েকটি কাক ও আর সেই পাখিটাকে দেখতে পেল। শুভ দেখল, পাখিটা অনেকখানি বড় হয়ে গেছে। মুখে সুর এসেছে। কিন্তু অবাক হলো এই ভেবে, পাখিটি শুভদের বাড়ি ছেড়ে এখনো চলে যায়নি। শুভ আম্মুকে ডেকে বলল, ‘দেখ আম্মু, পাখিটি এখনো আমাদের বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যায়নি।’ ওর আম্মু দেখে অবাক হলেন। বললেন, ‘আসলে, ওরা তো অবুঝ। তারপরও ওরাও মানুষের মন বোঝে। কিন্তু খাঁচায় বন্দি থাকাটা কখনো মেনে নিতে পারে না। আকাশ ওদের কাছে খুব প্রিয়। ওকে আমরা বাঁচিয়েছি। ও তাতে খুশি। তুমি যে ওকে পোষ মানাতে চেয়েছ, ও তা বুঝতে পেরেই এখানে রয়েছে হয়তো।’ তারপর শুভ তার মাকে বলল, ‘হ্যাঁ মা, পাখিকে যে খাঁচাতেই পুষতে হবে, এমন কোনো কথা হতে পারে না। পশুপাখিকে ভালোবাসা দিলে তারা এমনিতেই পোষ মেনে যায়।’
"