শামীম শিকদার

  ১৯ মে, ২০১৮

মায়ের আঁচল

খুব রাগ করেই বাসা থেকে বের হলাম। এতটাই রেগেছিলাম যে, পুরোনো জমা-কাপড় পরেই চলে এসেছি। খুব রাগ হচ্ছে মায়ের ওপর। টাকা দিতে পারবে না, তবে ছেলেকে কলেজে পড়ানোর এত শখ কেন? প্রতিদিন কলেজে যাওয়ার সময়ই ছোটখাটো একটা ঝগড়া করতে হয় সামান্য কিছু টাকা নিয়ে। ১০ টাকা কলেজে যাওয়ার বাসভাড়া ২০ টাকা দিয়েই বলে, বাবা আজ আর টাকা নেই। তখনই আমার মেজাজ বিগড়ে যায়। শুধু বাসভাড়া নিয়ে কি কলেজে যাওয়া যায়? এ কারণে প্রায় সময়ই কলেজে যাওয়া হয় না। আজকে ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল। সকাল সকাল সামান্য কিছু টাকার জন্য মেজাজ বিগড়ে গেল। কী দরকার ছিল, টাকাটা দিয়ে দিলেই পারত। এমন কিছু ভেবে ভেবেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। বাসস্ট্যান্ডে এসে বসলাম, বাসে উঠব। আর মনে মনে মায়ের ওপর খুব রাগ হচ্ছে। টিকিট নিয়ে বাসে উঠে বসলাম। অনেকটা শীত শীত অনুভব হলো। কিন্তু কিছু করার নেই। কারণ, সঙ্গে কোনো শীতের কাপড় নেই। বাসের জানালাটা বন্ধ করে দিলাম, পাশে বসেছেন এক ভদ্রলোক। আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাস সামনের স্টপেজে থামা মাত্রই বাসে উঠল মধ্য বয়সী একটি মেয়ে। শরীর প্রায় ভেজা। কারণ, বাইরে অবিরত রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে। মেয়েটি আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি এমনটাই অনুভব করতে পারলাম। পাশে এসেই বলল, আপনি একটু উঠে দাঁড়াবেন, প্লিজ? আমি অনেকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, কেন দাঁড়াব? মেয়েটি উত্তরে বলল, একটি মেয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, বসতে দেবেন না? এমনিতেই মেজাজটা গরম মেয়ের কথা শুনে আরো গরম হয়ে গেল। আমি বললাম, মেয়ে হয়েছেন তো পুরো পৃথিবীটাই কামাই করে ফেলেছেন। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, মেয়েটি লজ্জিত বোধ করছে। অবশেষে আমার সিটে মেয়েটিকে বসতে দিলাম। আমি সিটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছি মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে বিরক্ত বোধ করছি। প্রতিদিন বাসে করেই কলেজে যাই; কিন্তু কোনো দিনই এমন মনে হয় না। আজকে অতিরিক্ত রাগের কারণে ভালো কথাগুলোও মন্দ মনে হচ্ছে। ভেজা জামা-কাপড়েই এক পুরোনো বন্ধুর বাসায় উঠলাম। পুরোনো বলতে আমার স্কুলজীবনের বন্ধু জাহিদ। স্কুলে আমাদের দুজনের খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু কলেজে দুজন আলাদা হয়ে গেলেও বন্ধুত্ব আলাদা হয়নি। প্রায় সময়ই ওর সঙ্গে ফোনে কথা হয়। বাসায় আসতে বলে তাই আজ অনেকটা অজুহাত ধরেই চলে এসেছি। কিন্তু বাসায় এসে দেখি জাহিদ নেই, মামাবাড়ি বেড়াতে গেছে। কোনো উপায় না পেয়ে রুমের ভেতরেই বসলাম। ভেজা কাপড়গুলো শুকাচ্ছে। কিন্তু জাহিদকে ছাড়া কতক্ষণ বসে থাকা যায়? বাধ্য হয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে বের হয়ে পড়লাম ইয়াসিনের বাড়ির উদ্দেশে। টিকিট ছাড়াই একটি লোকাল বাসে উঠে বসলাম। কারণ, পকেটে টাকা একেবারেই কম। বৃষ্টিটা অনেকটা থেমেছে কিন্তু আমার কাপড় পুরো ভেজা। ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। আজ কলেজে যাওয়া হয়নি। কেবল মায়ের ওপর রাগ করেই। তবে যেহেতু টাকার জন্য কলেজে যেতে পারিনি, তাই আর বাসায় যাব নাÑএমনটাই ইচ্ছা।

বাস থেকেই রাস্তায় দেখতে পেলাম কতগুলো ছেলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স ৮-১০ বছরের মতো হবে। পরনে ছেঁড়া-নোংরা জামা-কাপড়। হাতে কতগুলো পত্রিকা। বাস থামতেই ওইসব ছেলের মধ্য থেকে একটি ছেলে আমাদের বাসের দিকে এগিয়ে আসছে, হাতে পত্রিকাগুলো। ‘এই খবর নিন...খবর নিন...তাজা খবর...’ এভাবেই চিৎকার করছে। ছেলেটিকে দেখে আমার খুব শৈববের কথা মনে পড়ছে। যে সময় আমরা এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে বেড়াতাম বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে কিনতাম নানা ধরনের চকলেট, হাতে থাকত বাহারি খেলনা। কিন্তু এ কেমন মায়ের সন্তান, যার হাতে আজ পত্রিকা। যে হাতে থাকার কথা ছিল খেলনা ও খাতা-কলম, মুখে থাকার কথা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় ডাক বাবা-মা। অনেক ইচ্ছা হলো ছেলেটির সম্পর্কে জানতে। তাই ছেলেটিকে ডাক দিয়ে আমার পাশের সিটে বসিয়ে নাম জানতে চাইলাম। কিন্তু ছেলেটি চট করে বলে ফেলল, ‘আমি বইতাম না, কি কইবেন তা কইন আমার পেপার বেচার লাগব।’ আমার পকেটে তেমন টাকা নেই তবু পকেট থেকে কিছু হাতে দিয়ে তার সম্পর্কে জানতে চাইলাম। কিন্তু যা শুনলাম তাতে এক শ্রেণির মানুষ নামে কথিত প্রাণীর ওপর জন্মাল ঘৃণা। ছেলেটির বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার মা তাকে রেখে চলে যায়। তারপর থেকে পাওয়া না পাওয়ার মাঝে বাবার কাছেই বেড়ে ওঠা। কখনো অনাহারে কখনো অর্ধাহারে কাটে তার জীবন। বাবা একজন হকার। এ শহরেই অলি-গলিতে হকারি করে। কখনো পুলিশের, কখনো চাঁদাবাজদের কারণে জোটে না তাদের চাহিদামতো খাদ্য। তাই আজ এই ৮-১০ বছরের ছেলেটি হকার। শুধু পেট ভরে তিনবেলা খাওয়ার জন্য এ ছেলেটির হাতে আজ পত্রিকা। যেখানে নেই কোনো মায়ের খোঁজ, নেই বাবার আদর। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ছেলেটি বিক্রি করে পত্রিকা। কিন্তু আমি কয়েকটি টাকার জন্য মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে চলে এসেছি। ভাবতেই নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছে। ইয়াসিনের বাসায় আর যাওয়া হলো না। ভেজা কাপড় নিয়েই প্রায় সন্ধ্যার দিকে আমাদের বাড়িতে চলে আসলাম।

রুমের ভেতরে লাইট জ্বলছে। বাবা বাসায় নেই জানি। কারণ, বাবা অফিস থেকে বাসায় ফিরে প্রতিদিন রাত ১০টার পর। অনেকটা চোরের মতো রুমের ভেতরে ঢুকলাম। মা রুমের ভেতরে এক কোণে বসে বসে কাঁদছে। আমারও মাকে দেখে অনেকটা চোখে পানি চলে আসছে, অনেক কষ্টে আটকে রাখলাম। আমার মতো মা কি রাগে কাঁদছে, নাকি কষ্টে? মায়ের কাছে আমার ভুল স্বীকার করে নিলাম। মা আমি বুঝতে পারিনি, আমাদের থেকেও কষ্টে মানুষ জীবনযাপন করছে। মুখে একমুঠো খাদ্য দেওয়ার জন্য সারা দিন পরিশ্রম করে। তুমি তো আমাকে অনেক আদর করো, অনেক বেশি ভালোবাস। মায়ের কান্নাটা বেড়ে গেল। মা আমাকে জরিয়ে ধরল। আমিও কাঁদতে শুরু করলাম।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist