রুহুল আমিন রাকিব

  ০৫ মে, ২০১৮

ভাগ্য বিড়ম্বনা

বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। একবার দুবার, তিনবার। ফোন বেজেই চলছে। নাহ্, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই শুভর। বাড়ি থেকে শুভর বাবা ফোন করছে। শুভর বাড়ি উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চল কুড়িগ্রামের দুর্গাপুর ইউনিয়নের কামাল খামার নামের গ্রামে। শুভর বাড়িতে শুভ ছাড়াও আরো দুই ভাই আছে। শুভ ওদের থেকে বড়। পড়ালেখা করার খুবই ইচ্ছে ছিল শুভর। তবে কথায় আছে না, কপালে দুঃখ থাকলে ভাতে কী করে। আজন্মকাল থেকে দুঃখ যার সঙ্গী, সে কি আর পড়ালেখা করতে পারে? শুভর বাড়িতে পারিবারিক অবস্থা একদম খারাপ, নুন আনতে পান্তা শেষ। শুভর বাবা গরিব মানুষ, গ্রামে কৃষিকাজ করে কোনো রকমে খেয়ে-পরে দিন চলে যায় ওদের। এমনও দিন আছে যে শুভদের বাড়িতে চুলায় আগুন জ্বলে না। ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করতে করতে কত রাত যে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে শুভ। এর যেন সঠিক কোনো হিসাব নেই শুভর কাছে। এই তো কিছুদিন আগে প্রচন্ড রকম কালবৈশাখী ঝড়-তান্ডব চালিয়ে গেল শুভদের বাড়ির ওপর দিয়ে।

সেই রাতে শুভদের থাকার জায়গা, একমাত্র কুঁড়ে ঘরটা নিমিশেই চোখের পলকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে যায় বৈশাখী ঝড়। সেদিন রাতের কথা মনে করতেই আঁতকে উঠে শুভ। সেদিন রাতের পর থেকে এক রকম খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে শুভর পরিবার। অনেক ভেবেচিন্তে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে জীবনের প্রয়োজনে গাজীপুরের শফিপুরে দূরসম্পর্কের এক পরিচিত মামার কাছে চলে আসে শুভ। কত হবে শুভর বয়স! এ তো সবে মাত্র ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিল। অথচ, জীবনের প্রয়োজনে আজ শুভকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যে বয়সে শুভর প্রাণ খুলে হাসি গান করে বেড়ানোর কথা, বন্ধুদের আড্ডায় জমিয়ে কথা বলা, আজ সেই বয়সে শুভর কাঁধে সংসার চালানোর বিশাল দায়িত্ব।

পরিবারের ছোট্ট দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচের জোগান দেওয়া। সংসার চালানোর জন্য বাবার কাছে টাকা পাঠানো। এই অল্প বয়সে জীবন চলার পথে অনেক কিছুই বুঝেছে শুভ। বাস্তবতার কাছে হার মেনেছে শুভর সৃজনশীল ভাবনাগুলো। কত সুন্দর করে ছন্দময় ছড়া, কবিতা, অনুগল্প লিখত শুভ, আজ বাস্তবতার কাছে হার মেনে সবকিছু যেন ভুলতে বসেছে শুভ। চলার পথে প্রতিটা বাঁকে বাঁকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে শুভকে। শুভ একটি ডাইং ফ্যাক্টরিতে মেকানিক্যাল সেকশনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খুবই সামান্য বেতনে হেলপার পদে চাকরি করে। প্রতিদিন আট ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর প্রতি সপ্তাহে আরো বাড়তি কয়েক ঘণ্টা ওভারটাইম করে শুভ। মাস শেষে বাড়তি কর্মঘণ্টার টাকা মিলিয়ে মাত্র সাত থেকে আট হাজার টাকা বেতন উঠিয়ে নিজের থাকা-খাওয়ার বিল পরিশোধ করে, বাদবাকি যে কয়েক টাকা হাতে থাকে, বাবা-মা ও ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেয় শুভ।

অনেক কষ্ট করে দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে সততার সঙ্গে চাকরি করে যায় শুভ। দেখতে দেখতে কয়েক মাস চলে গেল।

শুভর একটুও ভালো লাগে না এই বন্দিজীবন, এত কষ্টের কাজ করতে। বারবার মনে পড়ে বাড়িতে বাবা-মা ও আদরের ছোট্ট দুই ভাইয়ের কথা। তবে নিয়তির কাছে পরাজিত হয়ে এক ধরনের বাধ্য হয়ে কাজ করতে হচ্ছে শুভকে। গাঁয়ের বাড়িতে শুভর বাবা অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে কোনো রকমে দিন চলে যাচ্ছে ওদের সংসার। শুভ মাস শেষে যে টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। শত কষ্টের মাঝেও শুভর মা সেই টাকা খেয়ে না খেয়ে জমিয়ে রাখছে নিজের কাছে, কয়েক মাসের টাকা একখানে করে, কয়েক বান টিন কিনে এনে আবার বাড়িতে একটা নতুন ঘর উঠাল শুভর বাবা। দূর থেকে সেই টিনের চালে উত্তরের সূর্যর আলো এসে যখন উঁকি মারে, আহা মনে হয় যেন খুশির দমকা হাওয়া এসে ঢেউ খেলে যায় শুভর বাবা-মায়ের মনে। শুভর বাবা-মা, দুই হাত তুলে দোয়া করে। মনে মনে ভাবে এই বুঝি ভাগ্য ওদের মুখ পানে তাকিয়েছে!

তবে গরিবের কপাল যেসব সময় পোড়া থাকে, বেশি সুখ যে গরিবের জন্য নয়, ওই বিধাতা সেই কথা যেন আরো একবার অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে দিলেন শুভর বাবা-মায়ের কাছে। প্রতিদিনের মতো আজ সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অফিসে গিয়েছিল শুভ। অফিসে গিয়ে একটা নষ্ট মেশিনের কাজ করছিল শুভ। হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেশিনের সমস্ত রোলার ও গ্রিয়ার মোটর চলতে শুরু করল। চিৎকার করে কেঁদে উঠল শুভ! শুভর চিৎকারের শব্দ শুনে মেশিনের সুইচ অফ করে দেওয়া হলো। কিছু কবুতর ডানা ঝাপটে উড়ে গেল ফ্যাক্টরির ভেতর থেকে। মুহূর্তের মধ্যে লোকের ভিড় জমে গেল, অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর মেশিনের প্যাডারের ভেতর থেকে বের করা হলো শুভর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া ডান হাত। প্যাডারের প্রচন্ড চাপে শুভর ডান হাতের সমস্ত হাড় ভেঙে চামড়ার সঙ্গে মিশে গেছে। তাড়াতাড়ি শুভকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হলো। কর্তব্যরত ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেও জোড়া লাগাতে পারলেন না হাত। অবশেষে শুভর দেহ থেকে আলাদা করে ফেলা হলো হাত।

দায়সারাভাবে যা একটু চিকিৎসা করেছিল কোম্পানির মালিকপক্ষ। এর পরে আর কখনোই খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি মালিকপক্ষ। আর হাত হারিয়ে শুভ আজও ফ্যাল ফ্যাল করে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। আমাদের দেশের স্বার্থলোভী মালিকরা একটার পর একটা মিল-কারখানা গড়ে তুলছে আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে। অথচ, কত শত শুভ এভাবেই দিনের পর দিন তাদের স্বপ্নগুলো নিজ হাতে কবর দিচ্ছে সামান্য বেতনের চাকরিতে এসে। না আছে ওদের জীবনের নিরাপত্তা, না আছে কাজের মধ্যে স্বাধীনতা। এমনকি মৃত্যুর পরে লাশটাও গাঁয়ের বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়, অন্য শ্রমিক ভাইদের কাছ থেকে টাকা চাঁদা তুলে সাহায্যে নিয়ে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist