রব নেওয়াজ খোকন
গল্প
ভাগাভাগি
বছর ঘুরে ঠিক চলে এলো সেই দিনটি। দিনটির জন্য কত না অপেক্ষা আর দিনগোনা। ‘পহেলা বৈশাখ’ বলে কথা। আনন্দ যেন ঈদ কিংবা পূজার আনন্দকেও ছাড়িয়ে। এত বাহারি আর বিচিত্র খেলনার আয়োজন আর কোথাও কি মেলে?
পাড়ার সহপাঠীদের আজ ভোর ছয়টার আগেই ঘুম ভেঙেছে। পান্তা-ইলিশ খাওয়ার মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে দিন। মেহজাবিন, রাবেয়া, রাইসা, আলিফ, তাহসিনসহ সবার চোখেই আজ আনন্দের উপচে পড়া ঢেউ। ওরা সবাই বেগম রোকেয়া প্রি-ক্যাডেট অ্যান্ড হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রী। ওদের দলে প্রায় ১২-১৩ জন। সবাই মিলে একসঙ্গে মেলায় যাবে বলে ঠিক করেছে ওরা। স্কুলের মাঠেই বসবে বৈশাখী মেলা। স্কুল-কর্তৃপক্ষ মেলার আয়োজন করেছে। কাকডাকা ভোর থেকেই শুরু হলো মেলায় যাবার প্রস্তুতি। কে কী কিনবে, তার তালিকাও দুদিন আগে থেকেই চূড়ান্ত। এখন শুধু মেলায় যাওয়া এবং কেনাকাটার পালা।
খুব সকাল সকাল জমে উঠল মেলা। মেহজাবিনদের সহপাঠীর দলটা মেলায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশটা সম্পূর্ণ বদলে গেল। যেন দুনিয়ার তাবৎ আনন্দ এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেলার মাঠে। যে যার ইচ্ছেমতো খেলনা আর খাবার কেনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাঁশি, ঢোল, সানাই, বন্দুক, পিস্তল, গাড়ি, ঘড়ি, ঘুড়ি, মোবাইল, তলোয়ার, মাটির পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল সবই উঠেছে মেলায়। এ ছাড়া গ্রামীণ সব মজাদার খাবার যেমন, মুড়ি-মুড়কি, খৈ, বাতাসা, নাড়–, লাড্ডু, জিলাপি আরো কত কী!
কেনাকাটার কাজ শেষ। মেহজাবিনদের দলের সবাই যেন খেলনা আর খাবারে বোঝাই করা ট্রাক হয়ে বাড়ি ফিরছে। ওদের দলের ছেলে ফাহিমের হঠাৎ চোখ পড়ল পেছনের দিকে। ময়লা জামাকাপড় পরা একটা সমবয়সী বালক ওদের পিছুপিছু আসছে। সম্পূর্ণ খালিহাত। কোনো প্রকার খেলনা বা খাবার ওর হাতে দেখা যাচ্ছে না। এমন আনন্দের দিনে এক টুকরো হাসিরও চিহ্ন নেই বালকটির মুখে। কে এই বালক? ফাহিম সবাইকে ইশারা করে দেখাল। থমকে দাঁড়ালো সবাই। সবার চোখ পড়তেই বালকটি লাজুক হেসে মাথা নোয়ালো। রাস্তার পাশে বালকটিকে ঘিরে দাঁড়াল সবাই। দলের ডানপিটে ছেলে সুমন ওকে মারার ভঙিতে এগিয়ে গেল। সে বালকটিকে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করল,
-এই চোরা, মতলবটা কী শুনি? খেলনার লোভে পিছু নিয়েছিস বুঝি? ঘুষি মেরে একেবারে নাক ফাটিয়ে দেব।
বালকটি ভয়ে কেঁপে উঠল। কিছুই বলতে পারছে না। শুধু মাথা নেড়ে বুঝাতে চাইল সে এমন ধরনের ছেলে নয়। দলের ছেলে আলিফ সুমনকে থামাল।
-থামো সুমন। ওকে মেরো না। ওকে আমি চিনি। আমাদের পাশের বাড়ির নতুন ভাড়াটে। বাবা রিকশাচালক। বড় ভালো ছেলে।
আলিফের কথায় সবার সন্দেহ দূর হলো। দলনেত্রী মেহজাবিন সবার উদ্দেশে বলল-
-তোমরা ওকে ভুল বুঝেছ। আমরা ওকে না চিনলেও ও আমাদের চেনে। সেজন্যেই হয়তো আমাদের দলে মিশতে চাইছে। কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল করেছ? ওর হাতে একটাও খেলনা নেই এবং কোনো খাবারও নেই। হয়তো গরিব বাবার সন্তান বলেই কেনার সামর্থ্য নেই। খানিকটা থেমে মেহজাবিন আবার বলতে লাগল-
-আমাদের তো অনেক খেলনা। চলো, আমরা প্রত্যেকেই একটি খেলনা করে ওকে উপহার দিয়ে দিই এবং সঙ্গে কিছু খাবার। তাতে ওরও আমাদের মতো অনেকগুলো খেলনা হয়ে যাবে। তখন আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। বইয়ে নিশ্চয় সবাই পড়েছি যে, ধনী-গরিবে কোনো ভেদাভেদ করা উচিত নয়। অসহায় কিংবা মিসকিনদের সাহায্য করা নৈতিক দায়িত্ব। নববর্ষের এই আনন্দঘন দিনটি থেকে ও বঞ্চিত হবে কেন? আমরা ওকে আনন্দের ভাগ দিতে চাই।
মেহজাবিনের কথায় সবার মন সদয় হয়ে উঠল। প্রত্যেকে একটি করে খেলনা ও কিছু খাবার অসহায় বালকটিকে উপহার দিল। বালকটির দুহাত ভরে গেল খেলনা ও খাবারে।
ওর কষ্টের ছায়ামাখা মুখম-ল জুড়ে আনন্দের আলো ছড়িয়ে পড়ল। আর সে আলোর জ্যোতি নবর্ষের প্রথম দিনটিকে
রাঙিয়ে দিল।
"