আবদুস সালাম

  ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮

গল্প

সুপ্তনিধির রাজা

অনেক দিন আগের কথা। সুপ্তনিধি নামে একটি রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের রাজার নাম ছিল আসিফ আলী খান। তিনি যেমন দক্ষ শাসক ছিলেন, তেমনি ছিলেন প্রজাবৎসল। তিনি প্রজাদের দুঃখ-বেদনায় সব সময় ব্যথিত হতেন। তার রাজ্যে কীভাবে প্রজারা সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারে সেই চেষ্টায় তিনি সর্বদা মগ্ন থাকতেন। কেউ বিপদ-আপদে পড়লে রাজার লোকজন তাদের তাৎক্ষণিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। রাজদরবারে এসে কেউ রাজার কাছে সাহায্য চাইলে রাজা তাকে খালি হাতে ফেরাতেন না। আর এ কারণেই রাজাকে সবাই ভালোবাসত।

সুপ্তনিধি ছিলেন ধনসম্পদে পরিপূর্ণ। আশপাশের শক্তিশালী রাজ্যগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে সুপ্তনিধি আক্রমণ করতেন। সুপ্তনিধি রাজ্যের সৈন্য-সামন্তরা যেমন ছিলেন সাহসী, তেমনি ছিলেন যুদ্ধে পারদর্শী। রাজার পরামর্শ নিয়ে সেনাপ্রধান মোতাবেক যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। তাই খুব সহজেই তিনি অন্য রাজ্যের সৈন্যদের পরাজিত করতে পারতেন। রাজ্যের ধনসম্পদ লুট করার জন্য মাঝেমধ্যে দস্যুরাও আক্রমণ করত। পাহাদাররা সজাগ থাকার কারণে দস্যুরা তেমন সুবিধা করতে পারত না। তাই রাজার শাসনে রাজ্যের সবাই সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করত।

রাজা আসিফ কারিগরের মনে একটা দুঃখ ছিল। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তার কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। যত দিন যাচ্ছিল রাজার মনের দুঃখটা ততই বাড়তে ছিল। একদিন রাজা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রাজার অসুস্থতার খবর শুনে রাজকর্মচারীরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। রাজার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে কে পরবর্তী রাজা হবেন? কে সুপ্তনিধির শাসনভার গ্রহণ করবেন? এসব নানান কথা চিন্তা করে তারা হতাশ হয়ে গেল। সুপ্তনিধির প্রসিদ্ধ হেকিম ও ডাক্তারদের রাজপ্রাসাদে ডেকে এনে তারা রাজার চিকিৎসা করাল। চিকিৎসকদের সেবা-যতেœ রাজা কিছুদিনের মধ্যেই দ্রুত সুস্থ হয়ে গেলেন। রাজা সুস্থ হয়ে গেলে প্রজাদের মুখেও হাসি ফুটে উঠল।

রাজা একদিন মনে মনে ভাবলেন, আমার মৃত্যুর পর সুপ্তনিধির পরবর্তী রাজা কে হবেন? রাজা কোনো উত্তর পেলেন না। তিনি ভাবলেন, আমি যদি পরবর্তী রাজার নাম ঘোষণা করে না রাখি তাহলে রাজা নির্বাচন নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, হানাহানি সৃষ্টি হবে। তাই পরবর্তী রাজা নির্বাচনের জন্য বর্তমান রাজা কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ উপলক্ষে রাজা তার সভাসদদের নিয়ে একটি সভা করার জন্য দিন ধার্য করলেন। সভার দিন রাজা সবার উদ্দেশে বললেন : আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিÑসুপ্তনিধি রাজ্যে যত শিশু আছে তাদের সঙ্গে রাজপ্রাসাদে কয়েক দিন কাটাব। আপনারা সারা রাজ্যে আমার সিদ্ধান্তিটি এলান করে দিন। যারা আগ্রহী আছেন তারা যেন আগামী সপ্তাহে রাজপ্রাসাদে তাদের শিশুসন্তানদের নিয়ে চলে আসে। শিশুদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য রাজা সব রাজকর্মচারীর দায়িত্ব বণ্টন করে দিলেন। রাজার আদেশ অনুযায়ী রাজকর্মচারীরা কাজ শুরু করল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুপ্তনিধির আগ্রহী অভিভাবকরা তাদের শিশু-সন্তানদের রাজপ্রাসাদে হাজির করা হলো। তারা তাদের সন্তানদের রাজার লোকজনের কাছে রেখে যে যার মতো চলে গেল।

রাজপ্রাসাদে রেখে যাওয়া শিশুদের সঙ্গে রাজা কথাবার্তা বললেন, তিন বেলা খাওয়া-দাওয়া করলেন, তাদের সঙ্গে নিয়ে অফিস-আদালত পরিদর্শন করলেন, দরবার হলে অতিথিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং মজার মজার গল্প শোনালেন। এভাবে তিন দিন অতিবাহিত করার পর রাজা আসিফ আলী খান প্রত্যেক শিশুকে একটা করে উপহার দিয়ে বিদায় দিলেন। একদিন পর রাজা তার এক বিশ্বস্ত রাজকর্মচারীকে আদেশ দিলেন, রাজপ্রাসাদে যেসব শিশু এসেছিল তার মধ্যে একজনের নাম ছিল রাকিব হাসান। তুমি আগামীকাল রাকিব ও তার বাবাকে আমার কাছে হাজির করবে। রাজকর্মচারী রাজার হুকুম যথাযথভাবে পালন করার জন্য সেই ছেলেটির সন্ধানে বের হলো।

রাকিব হাসানের বাবা পেশায় ছিলেন ছুতার। তিনি বিভিন্ন নকশার কাঠের আসবাপপত্র তৈরি করতে পারদর্শী ছিলেন। রাজকর্মচারীর কাছে রাজার আদেশ শুনে তিনি বড্ড ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, আমার ছেলে বোধহয় রাজার সঙ্গে কোনো বেয়াদপি করেছে, তাই শাস্তি দেওয়ার জন্য রাজা আমাদের রাজপ্রাসাদে তলব করেছেন। পরের দিন ওই ছুতার ভয়ে ভয়ে তার সন্তানকে নিয়ে রাজার সামনে উপস্থিত হলেন। বাবা ভয়ে কম্পমান হলেও তার সন্তান রাকিব হাসান নির্ভয়ে রাজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। রাজা তাদের দেখে খুশি হলেন। রাজা ছুতারকে বললেন, আমি রাজপ্রাসাদে আপনাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছি। আপত্তি না থাকলে আপনারা এখন থেকে রাজপ্রাসাদেই থাকবেন। আর রাকিব হাসান রাজপ্রাসাদে থেকেই নিয়মিত লেখাপড়া শিখবে। রাজার প্রস্তাব শুনে ছুতার বললেনÑআপত্তি থাকবে কেন, রাজামশাই? এ যে আমার জন্য চরম সৌভাগ্যের বিষয়। অনেক বড় উপহার, অনেক বড় প্রাপ্তি। তিনি আবেগপ্লুত হয়ে পড়লেন। খুশিতে তার দুচোখ জলে ভরে গেল। অবশেষে রাজার হুকুমে তাদের রাজপ্রাসাদে থাকার ব্যবস্থা করা হলো।

একজন কাঠমিস্ত্রিকে রাজা কেন রাজপ্রাসাদে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন তা নিয়ে রীতিমতো রাজকর্মচারীদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। কারো কারো আবার ভীষণ ঈর্ষাও হলো। তারা লক্ষ করল রাজা রাকিব হাসানকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করতে শুরু করেছেন। রাজা তাকে খুব ভালোবাসেন। আর সব সময় তার সঙ্গে সঙ্গে রাখেন। রাজার এক ঘনিষ্ঠ কর্মচারী একদিন রাজাকে প্রশ্ন করল : একজন কাঠমিস্ত্রি ও তার ছেলেকে রাজপ্রাসাদের রাখার কারণ কী। রাজা তার প্রশ্নের উত্তরে বললেন : তোমরা জান যে, সুপ্তনিধি রাজ্যে অনেক শিশু বাস করে। কয়দিন আগে আমি তিন দিন তাদের সঙ্গে ছিলাম। আমি লক্ষ করেছি যে, সব শিশুর মধ্যে সেই ছিল ব্যতিক্রম। সব সময় আমাকে অনুসরণ করত। আমি যেভাবে চলাফেরা করি, কথাবার্তা বলি, খাওয়া-দাওয়া করি, পোশাক পরি, ওঠাবসা করি সেও আমার মতো ওই কাজগুলো করার চেষ্টা করত। আমি তাদের ‘রাজার বিচার’ নামে একটি গল্প শুনিয়েছিলাম। গল্পে রাজা যে অন্যায় করে একজন প্রজাকে শাস্তি দিয়েছিলেন তা একমাত্র রাকিব হাসানই বুঝতে পেরেছিল। শুধু তা-ই নয় এর প্রতিবাদস্বরূপ সে রাজার নিকট প্রশ্ন করেছিল। ওই শিশুদের মধ্যে সে ছিল বিচক্ষণ। সে জানে জীবনে বড় হতে হলে কাকে অনুসরণ করতে হবে। কাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হয়। আমি বুঝতে পেরিছি সে বড় হলে অনেক জ্ঞানী মানুষ হবে। আর তোমরা শিগগিরই বুঝতে পারবে রাকিব হাসানকে রাজপ্রাসাদে রাখার উদ্দেশ্য কী।

বেশ কিছুদিন পর রাজা লক্ষ করলেন যে, রাজা হওয়ার প্রায় সব গুণাবলি রাকিব হাসানের মধ্যে বিদ্যমান। রাজা আসিফ আলী খান একদিন রাজদরবারের এক সভায় তার সভাসদ এবং রাজ্যের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানালেন। সবার সামনে রাজা আলোচনা করলেন যে, আপনারা জানেন যে, আমি নিঃসন্তান। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তাই আমার উচিত ভবিষ্যতে কে সুপ্তনিধি শাসন করবে তার নামটি জানিয়ে দেওয়া। আজ আমি তার নাম ঘোষণা করব। আমার মৃত্যুর পর এ রাজ্যের পরবর্তী রাজা হবে রাকিব হাসান। যার বাবা পেশায় একজন ছুতার। বর্তমানে সে তার মা-বাবার সঙ্গে এ রাজপ্রাসাদেই বসবাস করছে। তবে রাকিব হাসানের বাবা কাঠমিস্ত্রি হলেও তার রাজা হওয়ার মতো যথেষ্ট গুণাবলি রয়েছে। তাকে যথাযথভাবে গড়ে তুললে সে-ই পারবে দক্ষতার সঙ্গে রাজ্য শাসন করতে। আমি সুপ্তনিধির পরবর্তী রাজা হিসেবে তাকেই মনোনীত করলাম। ভবিষ্যতে কে রাজা হবে তার ঘোষণা শুনে অনেকে খুশি হলো। আবার কেউ কেউ একটু সাহস করে এর প্রতিবাদও করল। অনেকে মনে মনে হিংসা করতে শুরু করল। কিন্তু রাজা কারোর কথায় কর্ণপাত করলেন না।

বর্তমান রাজা আসিফ আলী খান ভবিষ্যৎ রাজা রাকিব হাসানের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে হিংসুক রাজকর্মচারীদের সুকৌশলে রাজপ্রাসাদ থেকে বিদায় করে দিলেন। তারপর থেকে রাজা আস্তে আস্তে করে রাকিব হাসানকে নিজের সন্তানের মতো বড় করে তোলেন এবং রাজা হওয়ার যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলেন। কিছুদিন পর বৃদ্ধ রাজা একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বিখ্যাত চিকিৎসকরা শত চেষ্টা করে রাজাকে সুস্থ করে তুলতে পারলেন না। কদিন পরেই তার মৃত্যু হলো। রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী রাকিব হাসানই হলেন সুপ্তনিধির রাজা। খুব অল্পদিনের মধ্যেই নতুন রাজা প্রজাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। নতুন রাজাও প্রজাবৎসল রাজা হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হলেন। তার শাসনামলেও সবাই সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist