সারমিন ইসলাম রত্না
চন্দ্রমুখী
আমি একটি নদী। আমার নাম চন্দ্রমুখী। আমি ছলাৎছল কলাৎকল করে বয়ে চলি দূর থেকে দূরে। আমার জল আয়নার মতো স্বচ্ছ। সেই জলে পাল তোলা নৌকা ভাসিয়ে মাঝি ভাই আমাকে গান শোনায়। সুন্দরী চাঁদ আমার সেই আয়নার মতো স্বচ্ছ জলে প্রতিদিন তার রুপালি মুখটি দেখতে আসে। একদিন আমি তাকে বললাম বন্ধু তুমি সুন্দর, এতে কোনো সন্দেহ নেই, তাহলে কেন তুমি এত কষ্ট করে আমার জলে মুখ দেখতে আসো? চাঁদ বলল, বন্ধু তুমি একি বললে? আমি কি শুধু তোমার জলে মুখ দেখতে আসি, আমি তো তোমার সঙ্গে গল্প করতেও আসি। নদী বলল তাই বন্ধু! তুমি আমার সঙ্গে গল্প করতে আস, আমি অনেক খুশি হলাম। চাঁদ বলল, প্রতিদিন তোমার সঙ্গে মাঝির কণ্ঠে গান শুনতে আমার অনেক ভালো লাগে। এভাবেই নদীর সঙ্গে চাঁদের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল। নদী চাঁদকে পৃথিবীর গল্প শোনা তো আর চাঁদ নদীকে শোনা তো আকাশের গল্প। একদিন নদী কিছুটা অভিমান করেই চাঁদকে বলল, আজ কত দিন হয়ে গেল আমাদের বন্ধুত্বের, অথচ আমি একদিনও তোমার বাড়িতে বেড়াতে গেলাম না। তুমি কত দূরে থাক। চাঁদ মিষ্টি হেসে বলল, একদিন আমি ঠিকই তোমাকে আমার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাব। নদী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। চাঁদ আকাশের দিকে তাকাল, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, বন্ধু এখন আমি চলে যাচ্ছি, আবার আগামীকাল আসব, তোমার সঙ্গে গল্প করব। নদী আকুল হয়ে বলল, বন্ধু এখনই কেন যাচ্ছ? আর একটু থাক না। কিন্তু আমার তো যেতে হবে, আকাশে সূর্যের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ঠিক আছে বন্ধু তবে তুমি যাও। চাঁদ আস্তে আস্তে আকাশের কোলে মিলিয়ে গেল। নদী চুপচাপ তার জায়গায় ঘুমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ প্রচ- এক শব্দে নদীর ঘুম ভেঙে গেল। নদী চারদিকে তাকাল, তার চোখ যেন জ্বলসে যাচ্ছে। সূর্য নেমে এসেছে তার জলের খুব কাছে। সূর্য নদীকে বলল, এই তুই আমার বন্ধু হবি? নদী বলল না। সূর্য বলল কেন? কারণ তুমি আমাকে প্রথমেই প্রশ্নটি খুব বাজেভাবে করেছো। সূর্য ভিষণ রেগে গিয়ে বলল তবে রে! নদী কান্না কান্না চোখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এভাবে কেন আমার সঙ্গে কথা বলছো? কেনই বা তুমি এত উত্তাপ নিয়ে আমার কাছে এসেছো? সূর্য বলল, তুই প্রতিদিন চাঁদের সঙ্গে গল্প করিস, আমার খুব হিংসা হয়। তাই আমিও চাই তোর বন্ধু হতে। নদী বলল; কিন্তু আমি তো তোমার বন্ধু হবো না। সূর্য আরো রেগে গেল, রোদকে হুকুম করল, রোদ প্রখর হও, ছড়াতে থাকো তোমাদের উত্তাপ। নদী না না বলে চিৎকার করে উঠল। দুষ্ট সূর্যটা নদীর কথা শুনল না। রোদ বাড়ছে, নদী কষ্ট পাচ্ছে। রোদ বাড়ছে নদী চোখের জল ফেলছে। রোদ বাড়ছে নদীর জল শুকিয়ে যাচ্ছে, পরে যাচ্ছে তার বুকের ওপর শুকনো ঠনঠনে চর। নদী চিৎকার করে উঠল সূর্য এবার থাম, দয়া কর। সূর্য হেসে উঠল হা-হা, এখন বুঝবি কী আমার উত্তাপ। নদী আর কোনো কথা বলতে পারল না।
একদিন নদী দেখতে পেল তার সেই চরে মানুষ আসতে শুরু করেছে, শুধু তা-ই নয় তারা ঘরবাড়ি বানাতে শুরু করেছে, বানাতে শুরু করেছে বড় বড় দানব। দানবগুলো দেখতে এতই বিশ্রী, তারা আকাশের দিকে মুখ করে কালো ধোঁয়া ছাড়তে থাকে। কী বিষাক্ত সেই ধোঁয়া। ধীরে ধীরে নদীর চরে বাড়তে থাকল মানব ও দানবের উৎপাত। আয়নার মতো স্বচ্ছ জল কালো হয়ে উঠলÑসেই দানব থেকে ছুটে আসা বর্জ্য পদার্থে। এখন আর আগের মতো নৌকাগুলো পাল উড়িয়ে ভেসে বেড়ায় না, প্রচ- শব্দ করে দিক-বেদিক ছুটে বেড়ায়। নদীর খুব দুঃখ হয়, যন্ত্রণা হয়, সে কাউকে কিছুই বলতে পারে না।
একদিন সন্ধ্যাবেলা নদী মন খারাপ করে আকাশের দিকে তাকাল, দেখতে পেল বহু দূরে, বহুদূরের মেঘের ভেতর তার চাঁদ বন্ধুকে। চাঁদ বন্ধু তারদিকে তাকিয়ে কাঁদছে নদী চিৎকার করে ডাকল বন্ধুউউ, চাঁদ নদীর ডাক শুনে জবাব দিল বন্ধু তোমার এ কি অবস্থা! নদী বলল বন্ধু তুমি এত দিন কোথায় ছিলে? চাঁদ বলল আমি আকাশেই ছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে পাওনি, তোমাকে অনেক ডেকেছি, কিন্তু তুমি আমার ডাক শুনতে পাওনি। নদী বলল, আমি খুব ক্লান্ত তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বন্ধু, এখনো আমি ঘুমিয়েই আছি, আবার আগের মতো জেগে উঠব কিনা জানি না। চাঁদ বলল, বন্ধু তোমাকে জেগে উঠতেই হবে, আমি তোমাকে রক্ষা করব, তোমার জন্য গড়ে তুলব আন্দোলন। নদী অনেক দিন পর ছোট্ট একটা হাসি দিল, বলল যে মৃত হয়ে গেছে, যার আয়নার মতো স্বচ্ছ জল কালো হয়ে গেছে, যার বুকের ওপর বাসা বেঁধেছে অসংখ্য দানব, তাকে তুমি কেমন করে রক্ষা করবে? চাঁদ বলল, তুমি কোনো চিন্তা করো না বন্ধু, আমি আছি, আমি অবশ্যই তোমাকে রক্ষা করব।
সেই রাতেই চাঁদ আকাশের সমস্ত তাঁরাকে ডেকে পাঠাল। তাঁরারা দলে দলে ছুটে এলো চাঁদের কাছে। উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল কী হয়েছে তোমার? মন খারাপ কেন? বল তোমার জন্য কী করতে পারি? চাঁদ বলল, পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখ, একটি নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, ও মৃতপ্রায়, ওর জল কালো হয়ে গেছে, ওকে বাঁচাতে হবে, ও আমার বন্ধু। তাঁরাগুলো নদীর দিকে তাকালো। সত্যিই নদীটির অবস্থা খুব খারাপ। একটি তাঁরা বলে উঠল, ওকে আমরা অবশ্যই বাঁচাবো কিন্তু কীভাবে? পৃথিবীর মানুষেরা যেভাবে গাছপালা কেটে ফেলছে, আর বড় বড় কলকারখানা তৈরি করছে তাতে করে নদীটিকে বাঁচানো খুব কঠিন কাজ। চাঁদ বললো, সেই কঠিন কাজকেই সহজ করতে হবে আমাদের। তাঁরাগুলো চাঁদের সঙ্গে একটি আলোচনায় বসল এবং অনেক ভেবেচিন্তে খুঁজে বের করল একটি উপায়।
একদল শিশু মাঠে খেলা করছিল, দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি করছিল। হঠাৎ দেখতে পেল আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো রং-বেরঙের তাঁরা ঝরে পড়ছে। কে কার আগে তাঁরাগুলো ধরতে পারে, শুরু হয়ে গেল প্রতিযোগিতা। অবশেষে প্রত্যেকেই একটি করে তাঁরা হাতে পেল। অবাক হয়ে দেখল সেই তাঁরার গায়ে কিছু একটা লেখা আছে। সবাই সমস্বরে পড়তে শুরু করলÑ
আকাশের ঝিকিমিকি
ঝলমলে তাঁরা
পাঠালাম চিঠি মোরা
হয়ে দিশাহারা
চন্দ্রমুখী নদীটি
মৃতপ্রায় আজ
বাঁচিয়ে তোল তাকে
এই হলো কাজ
ছড়াটি পড়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠল শিশুরা। বলল, চল চল খবরটা সবার কাছে পৌঁছে দেই, নদীটাকে বাঁচিয়ে তুলি।
"