ভারতের পার্লামেন্টে জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন এবং বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সময় থেকে নিরাপত্তা বাহিনী অভিযানের নামে ভয়াবহ নির্যাতন ও অত্যাচার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন কাশ্মীরের বাসিন্দারা। অঞ্চলটির বেশ কয়েকটি গ্রামের অধিবাসীরা বিবিসির এক প্রতিবেদককে ‘সেনা সদস্যদের নির্যাতনে’ সৃষ্ট ক্ষতবিক্ষত শরীরও দেখিয়েছেন। বিবিসির খবরে এ কথা প্রকাশ করা হয়েছে।

সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে কাশ্মীরকে যে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া ছিল, তা বাতিলের পর সেনাবাহিনী গ্রামে গ্রামে ঢুকে যুবক ও তরুণদের লাঠি ও তার দিয়ে নির্বিচারে মারধর এবং বৈদ্যুতিক শক দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা। ভারতীয় সেনাবাহিনী এসব অভিযোগকে ‘মিথ্যাচার ও ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কাশ্মীরিদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও অত্যাচারের ঘটনাগুলো নিয়ে বিবিসিও নিশ্চিত হতে পারেনি।

চলতি মাসের শুরুতে পার্লামেন্টে বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর থেকে তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মীরকে দেশের অন্যান্য অংশ ও বহির্বিশ্ব থেকে ‘কার্যত’ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। উপত্যকাটিতে নতুন করে আরো কয়েক লাখ সেনা সদস্য মোতায়েনের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় ৩ হাজার সদস্যকে আটক ও গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। জেলখানায় জায়গা না হওয়ায় অনেককে ভারতের অন্য অঞ্চলগুলোতেও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলটির আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সতর্কতা হিসেবেই এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীরা উপত্যকাটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে জোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কাশ্মীরে অস্থিরতার জন্য নয়াদিল্লি প্রায়শই পাকিস্তানকে দায়ী করলেও কাশ্মীরের অন্য অংশের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা ইসলামাবাদ শুরু থেকেই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। বিবিসির প্রতিবেদক জানান, গত কয়েক বছর ধরে ভারতবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা কাশ্মীরের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোর কয়েকটি গ্রামে গিয়ে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মারধর ও নির্যাতনের অভিযোগ শুনতে পেয়েছেন।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জখম হওয়া রোগীদের নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি, তবে গ্রামবাসীদের অনেকেই সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে আমাকে তাদের শরীরে থাকা আঘাতের চিহ্ন দেখিয়েছেন, বলেছেন তিনি। ভারতের পার্লামেন্টে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের কয়েক ঘণ্টা পর সেনা সদস্যরা ঘরে ঘরে ঢুকে অভিযান চালানো শুরু করে বলেও এক গ্রামের বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন। ফের নির্যাতন হতে পারে, এমন আতঙ্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই ভাই জানান, সেনা সদস্যরা তাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে গ্রামের এক জায়গায় নিয়ে যান। সেখানে আরো অনেকের সঙ্গে তাদেরও বেদম মারধর করা হয়।

জানতে চেয়েছিলাম, ‘কী করেছি আমরা? আপনারা চাইলে গ্রামবাসীদের কাছে আমরা মিথ্যা বলছি কি-না, কোনো অন্যায় করেছি কি-না জিজ্ঞাসা করতে পারেন।’ কিন্তু তারা আমাদের কথা শুনতে চায়নি, বলেওনি কিছু। কেবল পিটিয়েছে, ভাষ্য এক ভাইয়ের। তিনি বলেন, তারা আমার শরীরের সব অংশে মেরেছে। লাথি মেরেছে, লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে, বৈদ্যুতিক শক দিয়েছে, তার দিয়ে পিটিয়েছে। তারা পায়ের পেছনে মেরেছে। যখন আমরা অচেতন হয়ে পড়তাম, তারা বিদ্যুতের শক দিয়ে আমাদের চেতনা ফিরিয়ে আনত। মারের চোটে আমরা যখন চিৎকার করতাম, তখন তারা কাদা দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করে দিত।

আমরা যে নিষ্পাপ তা বলেছি তাদের। কেন তারা এমনটা করছে তা জানতে চাইতাম আমরা। কিন্তু তারা আমাদের কথা কানেই তুলত না। আমি তাদের বলেছিÑ আমাদের না মেরে গুলি কর। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম আমাকে তুলে নিতে, কারণ ওই নির্যাতন সহ্য করা যাচ্ছিল না। অন্য এক গ্রামের আহত আরেক যুবক জানান, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রথমে তার কাছে ‘পাথর কারা ছুড়ছে, তাদের নাম জানতে চান’। জানি নাÑ এমনটা বলার পর তারা আমাকে চশমা, পোশাক ও জুতা খুলতে বলে। এরপর তারা রড ও লাঠি দিয়ে ঘণ্টা দুয়েক নির্দয়ভাবে পেটায়।

আমি অচেতন হয়ে গেলে তারা বৈদ্যুতিক শক দিয়ে আমার জ্ঞান ফিরিয়ে আনে।

তারা যদি এমন কিছু ফের করে, আমি যা ইচ্ছা তা করতে পারি। আমি বন্দুক তুলে নেব, প্রতিদিন এমন নির্যাতন নিতে পারব না আমি, বলেন তিনি। গ্রামের তরুণ-যুবক কেউ নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিবাদে অংশ নিলে তাদেরও এমন পরিণতি হতে পারে বলে সৈন্যরা তাকে সতর্ক করে দিয়েছে বলেও জানান তিনি। জঙ্গিদের তথ্য জানাতে না পারলে সেনা সদস্যরা মামলাজালে আটকে ফেলার হুমকি দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন বয়স ২০ এর ঘরে থাকা অন্য এক গ্রামের বাসিন্দা। সেনাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে এমনভাবে মারা হয়েছে যে দুই সপ্তাহ পরও তিনি ঘুমাতে পারছেন না।

এমনটা চলতে থাকলে বাড়ি ছেড়ে পালানো ছাড়া গতি নেই আমার। তারা আমাদের পশুর মতো মারছে। আমাদের মানুষ বলেই গণ্য করছে না, বলেছেন তিনি। শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখানো আরেক গ্রামবাসী ১৫ থেকে ১৬ সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে তাকে তার, বন্দুক, লাঠি ও রড দিয়ে বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ করেন। আমি অর্ধ-চেতন হয়ে পড়ি, তারা আমার দাড়ি ধরে এত জোরে টেনেছিল যে আমার মনে হয়েছিল দাঁত খুলে পড়বে, ভাষ্য তার। সেনাবাহিনী এ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

বিবিসিকে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা নিজেদের ‘পেশাদার সংগঠন যারা মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ বলে দাবি করেছে। গত পাঁচ বছরে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এনএইচআরসি) উত্থাপিত ৩৭টি অভিযোগের অধিকাংশই ‘ভিত্তিহীন’ প্রমাণিত হয়েছে বলেও বিবৃতিতে জানিয়েছে তারা। ১৫টি খতিয়ে দেখা হয়েছে, এর মধ্যে মাত্র তিনটি অভিযোগকে তদন্তযোগ্য হিসেবে পাওয়া গেছে। যারা দোষী বলে প্রমাণিত হয়েছে, তাদের সাজা হয়েছে, বলেছে তারা।

চলতি বছর কাশ্মীরের দুটি মানবাধিকার সংগঠন উপত্যকায় গত তিন দশকে হওয়া কয়েকশ’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সংবলিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিস্তৃত ও স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক তদন্তে সেখানে একটি কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনও। ওই অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর বাড়াবাড়ির অভিযোগ নিয়ে ৪৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনও দিয়েছে তারা। নয়াদিল্লি ওই প্রতিবেদনের অভিযোগগুলো অস্বীকার করে আসছে।

"