জাহিদ আকন

  ৩০ মে, ২০১৯

হ্যাটট্রিকের গল্পগুলো

টানা তিন বলে তিন ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরত পাঠানো মোটেও সহজ কাজ নয়। বোলারদের জন্য হ্যাটট্রিক মানেই বিশেষ কিছু। আর সেটা যদি হয় বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে, তা হলে তা জায়গা করে নেয় কিংবদন্তিদের খাতায়। ক্রিকেট বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত এমন কিংবদন্তিতুল্য ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৯ বার। প্রথম তিন আসরে মেলেনি কোনো হ্যাটট্রিকের দেখা। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে ভারতীয় বোলার চেতন শর্মা ছেড়েন সেই গেরো, করেন বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম হ্যাটট্রিক। এরপর ফের দুই বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিকের দেখা নেই। ১৯৯৯ সালের আসরে সাকলাইন মুশতাকের হাত ধরে ফিরে আসে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিকের কীর্তি। তারপর থেকে প্রতি বিশ্বকাপেই অন্তত ১টি করে হ্যাটট্রিক হয়েছে। এর মধ্যে আবার ২০০৩, ২০০৭ ও ২০১১ সালের বিশ্বকাপে হয়েছে দুটি করে হ্যাটট্রিক।

বিশ্বকাপে একের অধিক হ্যাটট্রিক করার রেকর্ড শুধু একজনেরই আছে। তিনি আর কেউ নন, ঝাঁকড়া চুলের বিধ্বংসী লঙ্কান পেসার লাসিথ মালিঙ্গা। দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি হ্যাটট্রিকের রেকর্ডও শ্রীলংকার দখলে (৩টি) এবং সবচেয়ে বেশিবার হ্যাটট্রিকের শিকার হয়েছে কেনিয়া (দুবার)।

এক নজরে বিশ্বকাপের হ্যাটট্রিক

১. চেতন শর্মা (ভারত বনাম নিউজিল্যান্ড, ১৯৮৭)

বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম হ্যাটট্রিক আসে চতুর্থ আসরে। ভারত-পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ৮৭-এর বিশ্বকাপে ভারত বনাম নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার গ্রুপ পর্বের ম্যাচটি সাক্ষী হয় প্রথম বিশ্বকাপ হ্যাটট্রিকের। সে ম্যাচে নাগপুরে ভারতীয় মিডিয়াম পেসার চেতন শর্মা পরপর তিন বলে সাজঘরে পাঠান তিন কিউই ব্যাটসম্যান কেন রাদারফোর্ড, ইয়ান স্মিথ এবং ইউইন চ্যাটফিল্ডকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চেতন শর্মা তিনজনকেই করেন ক্লিন বোল্ড।

২. সাকলাইন মুশতাক (পাকিস্তান বনাম জিম্বাবুয়ে, ১৯৯৯)

চেতন শর্মার হ্যাটট্রিকের দীর্ঘ এক যুগ পর আবারও ক্রিকেট মহাযজ্ঞে হ্যাটট্রিক দেখার সুযোগ পায় বিশ্ব। এবারও হ্যাটট্রিক করেন আরেক এশিয়ান, পাকিস্তানি সাকলাইন মুশতাক। লন্ডনের দ্য ওভালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাকলাইনের প্রথম শিকার ছিলেন হেনরি ওলোঙ্গা, মঈন খানের করা স্ট্যাম্পিংটি ছিল চোখে পড়ার মতো। দ্বিতীয় শিকার অ্যাডাম হাকলকে কট বিহাইন্ড করার পর পমি এমবাঙ্গোয়াকে এলবিডব্লিউ-এর ফাঁদে ফেলে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন সাকলাইন।

৩. চামিন্দা ভাস (শ্রীলঙ্কা বনাম বাংলাদেশ, ২০০৩)

দিনটি ছিল বিশ্ব ভালোবাসা দিবস তথা ১৪ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সেদিন কোনো ভালোবাসাই রাখেননি লঙ্কান বাঁহাতি পেসার চামিন্দা ভাস। পিটারমরিজবার্গে সেদিন বিশ্ব দেখেছিল এক অনন্য কীর্তি। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইনিংসের প্রথম তিন বলে ৩ উইকেট নেওয়ার বিরল রেকর্ড করে বসেন ভাস। তার ‘আনপ্লেয়েবল সুইং’য়ে একে একে সাজঘরে ফিরেছিলেন হান্নান সরকার, মোহাম্মদ আশরাফুল এবং এহসানুল হক সিজান। সে ওভারের পঞ্চম বলে সানোয়ার হোসেনের উইকেটও নিয়েছিলেন ভাস।

৪. ব্রেট লি (অস্ট্রেলিয়া বনাম কেনিয়া, ২০০৩)

কেনিয়ার বিপক্ষে ব্রেট লির হ্যাটট্রিকটি ছিল বিশ্বকাপে উপমহাদেশের বাইরের কোনো বোলারের প্রথম হ্যাটট্রিক। ভাসের হ্যাটট্রিকের ১২ দিনের মাথায় অস্ট্রেলিয়ান স্পিডস্টারের গতির তোপে সেদিন লন্ডভন্ড গিয়েছিল কেনিয়ার টপ-অর্ডার। ওপেনার কেনেডি ওটিয়েনোকে বোল্ডের পর, রিকি পন্টিয়ের হাতে ধরা পড়েন ব্রিজাল প্যাটেল। হ্যাটট্রিকের শিকার ডেভিড ওবুয়া ৯৭ মাইল বেগে আসা ব্রেট লির আগুন-গোলার সামনে দাঁড়াতেই পারেননি, হয়েছিলেন সরাসরি বোল্ড।

৫. লাসিথ মালিঙ্গা (শ্রীলঙ্কা বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০০৭)

একমাত্র বোলার হিসেবে বিশ্বকাপে দুটি হ্যাটট্রিকের পাশাপাশি ক্রিকেটের বিশ্ব আসরে চার বলে ৪ উইকেট নেওয়া একমাত্র বোলারও লঙ্কান লাসিথ মালিঙ্গা। ২০০৭ বিশ্বকাপে সুপার এইটের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পরপর চার বলে ৪ উইকেট নিয়ে ইতিহাসের পাতায় আলাদাভাবে জায়গা করে নেন মালিঙ্গা। দক্ষিণ আফ্রিকার তখন দরকার ছিল মাত্র ৪ রান, হাতে ৫ উইকেট। সে পরিস্থিতিতে আচমকাই শুরু হয় মালিঙ্গা ঝড়। পরপর দুই স্লোয়ারে সাজঘরে পাঠান শন পোলক এবং অ্যান্ড্রু হলকে। ওভার শেষ হয়ে যাওয়ায় হ্যাটট্রিকের জন্য অপেক্ষা করতে হয় নিজের পরবর্তী ওভারের জন্য। পরের ওভারের প্রথম বলে উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া জ্যাক ক্যালিসকে ফেরানোর পরের বলেই মাখায়া এনটিনির ওপর স্টাম্প উপড়ে ফেলেন। এই অনন্য কীর্তির পরও একবুক হতাশা নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন মালিঙ্গা। কারণ, সেদিন তার দল যে হেরেছিল ১ উইকেটে!

৬. কেমার রোচ (ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম নেদারল্যান্ডস, ২০১১)

উপমহাদেশে হওয়া বিশ্বকাপের সবশেষ আসরে প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলার হিসেবে হ্যাটট্রিক করেন কেমার রোচ। ২০১১ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের টেইল অ্যান্ডার ধসিয়ে দেন ৩ বলেই। ৩৩১ রানের টার্গেটে নামা নেদারল্যান্ডসকে ১১৫/৭ থেকে ১১৫/১০ পরিণত করার পথে রোচ একে একে ফিরিয়েছিলেন পিটার শিলার, বার্নার্ড লুটস এবং ব্যারেন্ড ওয়েস্টডাইককে।

৭. লাসিথ মালিঙ্গা (শ্রীলঙ্কা বনাম কেনিয়া, ২০১১)

এবার যেন ২০০৭-এরই পুনরাবৃত্তিই করেন মালিঙ্গা। সেবারের মতো ২০১১তেও আলাদা আরেকটি ওভার লেগেছিল মালিঙ্গার হ্যাটট্রিক পূরণ করতে। ব্যক্তিগত সপ্তম ওভারের শেষ বলে তন্ময় মিশ্রকে প্যাভিলিয়নে পাঠানোর পর অষ্টম ওভারের প্রথম বলে পিটার ওংগোডো এবং পরের বলে শেম এঙ্গোচেকে আউট করেন মালিঙ্গা।

৮. স্টিভেন ফিন (ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া, ২০১৫)

গেল আসরে প্রথম ইংলিশ বোলার হিসেবে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেন স্টিভেন ফিন। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) সেদিন অস্ট্রেলিয়ার পাহাড়সম রানের চাপে দিশাহারা ইংলিশদের একমাত্র প্রাপ্তি ছিল স্টিভেন ফিনের হ্যাটট্রিক। ইনিংসের শেষ ওভারে পরপর তিন বলে ব্রাড হ্যাডিন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এবং মিচেল জনসনের উইকেট শিকার করে শুধু হ্যাটট্রিকই করেননি ফিন, অজিদের ৩৫০ রানের মধ্যে বেঁধে ফেলতে রাখেন সবচেয়ে বড় ভূমিকা। যদিও ফিনের দল সেদিন হেরেছিল ১১১ রানের বিশাল ব্যবধানে।

৯. জেপি ডুমিনি (দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম শ্রীলঙ্কা, ২০১৫)

সবচেয়ে বেশিবার হ্যাটট্রিক করা দল শ্রীলঙ্কা, সে ম্যাচে নিজেই শিকার হয় হ্যাটট্রিক যাতনার। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ‘খন্ডকালীন স্পিনার’ জেপি ডুমিনির আচমকা ঘূর্ণিতে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডার। মালিঙ্গার মতো ডুমিনিরও লেগেছিল দুটি ভিন্ন ওভার। অষ্টম ওভারের শেষ বলে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে ফিরতি ক্যাচে আউট করে তিন উইকেটের প্রথমটি নেন ডুমিনি। পরে নবম ওভারের প্রথম বলে নুয়ান কুলাসেকারাকে ডি ককের ক্যাচে পরিণত করার পর থারিন্ডু কৌশলকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে প্রথম আফ্রিকান হিসেবে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করেন ডুমিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close