ডা. লিয়াকত হোসেন তপন
হার্টে অক্সিজেন কমে গেলে
চার প্রকোষ্টের হৃদযন্ত্র বা হার্ট আমাদের দেহের অত্যাবশ্যকীয় কেন্দ্রীয় অর্গান বা অঙ্গ। গুরুত্ব বিবেচনায় মস্তিষ্কের পরেই হৃৎপিন্ডের অবস্থান। হৃদযন্ত্র মানব দেহের জন্য অনেক জরুরি কাজ করে থাকে। হৃৎপিন্ড বা হার্ট যে কাজগুলো করে তা হলোÑ
দেহের প্রতিটি কোষে খাদ্যকণা (গ্লুকোজ, প্রোটিন ও ফ্যাট) পৌঁছে দেয়।
ফুসফুস থেকে বিশুদ্ধ অক্সিজেন কোষে কোষে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে।
বিশুদ্ধকরণের জন্য কোষ থেকে দূষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড ফুসফুসে পৌঁছে দেয়।
দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
শরীরের মেটাবলিজ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
দেহের প্রতিটি প্রান্তে ওষুধ পৌঁছে দেয়।
জীবনকে ছন্দময় করে।
দেহের প্রতিটি অংশে খাদ্য প্রদানকারী মহান বন্ধু হৃদযন্ত্র জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যায়। হার্ট নিজেই নিজেকে দুটি রক্তনালির মাধ্যমে অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে থাকে। এ দুটি রক্তনালির কমপক্ষে একটি আংশিক বা পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেলেই সমস্যা হয়। এরই নাম ‘ইসকেমিক হার্ট ডিজিস’ বা হৃদযন্ত্রে অক্সিজেন স্বল্পতা।
বুকে ব্যথাই এ রোগের আভাস দেয়। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় বিশ্রাম বা জিহ্বার নিচে নাইট্রেট স্প্রে বা ট্যাবলেট দিলেই বুকের ব্যথা কমে যায়। কিন্তু জটিল পর্যায়ে বিশ্রাম এবং নাইট্রেট জিহ্বার নিচে ব্যবহার করেও বুকের ব্যথা কমানো যায় না। হৃদযন্ত্রে অক্সিজেন স্বল্পতা ধীরে ধীরে জটিল আকার ধারণ করে।
কেন হৃদযন্ত্রে অক্সিজেনস্বল্পতা হয়
হৃদযন্ত্রে অক্সিজেনের চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য হলেই হৃদযন্ত্রে অক্সিজেন স্বল্পতা রোগ হয়।
হৃদযন্ত্রের রক্তনালিতে রক্ত চলাচল বন্ধ বা বাধাপ্রাপ্ত হলে রক্তনালির সংকোচন বা ব্লক কমপক্ষে ৭০ শতাংশ হলেই হৃদযন্ত্রের মাংসপেশিতে রক্ত তথা অক্সিজেন সরবরাহ কমে গিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। অক্সিজেন স্বল্পতার প্রাথমিক অবস্থা হচ্ছে ইসকেমিয়া বা অ্যানজাইনা। আর তীব্র বা প্রকট অবস্থা হচ্ছে ইনফারকশন বা হার্ট অ্যাটাক। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে, স্ট্রোক হার্টের কোনো রোগ নয়। স্ট্রোক মাথার অসুখ যখন মাথার রক্তনালি বন্ধ হয় বা ছিঁড়ে যায়। আর হার্ট অ্যাটাক হৃদযন্ত্রের রোগ। অনেক মানুষ স্ট্রোককে হার্ট অ্যাটাক ভেবে রোগীকে ভুল করে হৃদরোগ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আবার হার্ট অ্যাটাককে স্ট্রোক ভেবে মাথার সিটি স্ক্যান করাতে চান। কতিপয় বিশেষ শ্রেণির মানুষের হৃদযন্ত্রে অক্সিজেন স্বল্পতা বেশি হয়।
যেসব ক্ষেত্রে এ রোগের সম্ভাবনা বেশি থাকে
উচ্চ রক্তচাপ
ডায়াবেটিস মেলাইটাস
রক্তে অতিরিক্ত চর্বি/কোলেস্টেরল
স্থূলতা
পুরুষ
বার্ধক্য
কায়িক শ্রমহীনতা
খাদ্যে শাকসবজি কম থাকা
অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা
খাদ্যে অনিয়ম
পারিবারিক ইতিহাস
বেশি টিপটপ জীবনযাপন
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অত্যধিক চর্বি, পরিশ্রমহীনতা, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি।
হৃদযন্ত্রে রক্ত স্বল্পতার রোগী বুকে ব্যথা, শ্বাস কষ্ট, বুকে চাপ, বুক ভারি লাগা এসব লক্ষণ ছাড়াও বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে আসতে পারেন। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নিয়ে যেতে হবে। সন্নিকটে হৃদরোগের চিকিৎসা সুবিধা সংবলিত হাসপাতাল থাকলে সেখানে নিয়ে যাওয়াই উত্তম। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ধারাবাহিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
হাসপাতালে পৌঁছার আগে বাসায় বা কর্মস্থলে বা রাস্তায় যা করতে হবেÑ
পর্যাপ্ত আলো-বাতাস নিশ্চিত করতে হবে।
জিহ্বার নিচে নাইট্রেট স্প্রে দুই চাপ দিতে হবে বা একটি নাইট্রেট ট্যাবলেট দিতে হবে।
দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছার ব্যবস্থা করতে হবে।
হৃদযন্ত্রে অক্সিজেন স্বল্পতা চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ অধিক সহজ ও নিরাপদ। হৃদযন্ত্রে অক্সিজেনস্বল্পতা খুব কঠিন নয়। এ জন্য করণীয়Ñ
আদর্শ জীবনযাপন করা।
প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করা।
বেশি শাকসবজি খাওয়া।
ধূমপান, গিলা, কলিজা, মাথা, জর্দা ও গরুর গোশত বর্জন করা।
তেল, চর্বি, মিষ্টি কম খাওয়া।
পরিমিত বিশ্রাম ও ঘুম।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা কিডনির সমস্যা থাকলে চিকিৎসা গ্রহণ করা।
উত্তেজনা প্রশমন করা।
আলগা লবণ বর্জন করা।
দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করা।
লেখক : হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
"