ডা. এম ইয়াছিন আলী

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

শিশুর পায়ে ব্যথা হলেই বাতজ্বর নয়

রোহানের বয়স ৯ বছর। এ ছেলেটির প্রায়ই পা ব্যথা করে। বিশেষ করে পায়ের মাংসপেশিগুলোতে বেশি ব্যথা করে। যেদিন বেশি হাঁটাহাঁটি হয় কিংবা স্কুলে খেলাধুলা করে সেদিন সমস্যাটি বেড়ে যায়। এটি প্রথম দেখা দেয় তিন বছর আগে। তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তিনি কিছু পরীক্ষা করান। এর মধ্যে এএস ও টাইটার বেশি পেলে বাতজ্বর হয়েছে বলে প্রতিমাসে মাংসে পেনিসিলিন ইনজেকশন নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেই থেকে প্রতিমাসে ছেলেটি ইনজেকশন নিচ্ছে, তারপরও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাই তার মায়ের মনে প্রশ্ন, এত ইনজেকশন নিচ্ছে, তারপরও কেন এই পায়ে ব্যথা?

রোহানের মতো অনেক ছেলেমেয়ে এ রকম পায়ে-হাতে ব্যথার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তারা কিছু পরীক্ষা করান। আর এএস ও টাইটার বেশি পেলে বাতজ্বর আখ্যা দিয়ে বছরের পর বছর পেনিসিলিন ট্যাবলেট কিংবা ইনজেকশন দিতে থাকেন। পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে অনেকের বাতজ্বর ভুল প্রমাণিত হয়। তবে এ চিকিৎসায় শিশুটির শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি অনেক অর্থ এবং সময় অযথা নষ্ট হয়ে যায়।

বাতজ্বর কী?

বাতজ্বরকে ইংরেজিতে বলে রিউমেটিক ফিভার। এটা বাচ্চাদের একটি প্রদাহজনিত রোগ। গলায় স্ট্রেপটোকক্কাস নামের অণুজীবের সংক্রমণের পর তার বিরুদ্ধে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা আবার হৃৎপিন্ড, ব্রেইন, পিঠ, চামড়া ইত্যাদি স্থানের টিস্যুকে আক্রমণ করে প্রদাহজনিত রোগের সৃষ্টি করে।

বাতজ্বরে ঝুঁকিপূর্ণ কারা?

এটা সাধারণত ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সের বাচ্চাদের বেশি হয়। স্কুলের ছাত্রছাত্রী দলবদ্ধ হয়ে থাকা, কিংবা ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় বসবাস করলে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, তবে স্ট্রেপটোকক্কাস দিয়ে গলাব্যথা জাতীয় রোগ হওয়ার ৭ থেকে ৯ দিনের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করলে বাতজ্বর হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।

বাতজ্বর হলে বুঝবেন কী করে?

আগেই বলেছি, এই বাতজ্বর ব্রেইন, হৃৎপিন্ড, পিঠ, চামড়া ইত্যাদি অনেক স্থানকে আক্রমণ করে। তাই কোনো একক লক্ষণ কিংবা পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তাররা এটা নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করতে পারেন না। তাই অনেক গবেষণার পর একজন বিজ্ঞানী এটা নির্ণয়ের যে বৈশিষ্ট্য ঠিক করে দিয়েছেন, সে অনুসারে সেটা জোনস নির্ণায়ক এবং কিছু পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে পরিবর্তিত জোনস মানদন্ড নামে চিকিৎসকদের জন্য অবশ্য অনুকরণীয় হয়ে আছে। এ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তিনি পাঁচটি মুখ্য এবং কিছু গৌণ বৈশিষ্ট্য রেখেছেন, সেই সঙ্গে থাকতে হবে স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণের প্রমাণ।

মুখ্য বৈশিষ্ট্যের যে কোনো দুটি অথবা একটি মুখ্যের সঙ্গে দুটি গৌণ বৈশিষ্ট্য এবং সম্প্রতি স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে বাতজ্বর হিসেবে ধরতে হবে অন্যথায় নয়।

এই মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ-

১. হৃৎপিন্ডের প্রদাহ

২. হাত ও পায়ের বিভিন্ন জয়েন্টে প্রদাহ

৩. ব্রেইন প্রদাহজনিত কাঁপুনি বা খিঁচুনি

৪. চামড়ার লাল দাগ

৫. চামড়ার নিচে আর গৌণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে থাকতে পারে হাতে-পায়ে হালকা ব্যথা, জ্বর বেড়ে যাওয়া এবং দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া। তবে এদের সঙ্গে অবশ্যই সম্প্রতি সংক্রমণের প্রমাণ হিসেবে গলা পরীক্ষায় জীবাণুর অস্তিত্ব, বাড়তি টাইটার থাকতে হবে।

গৌণ বৈশিষ্ট্যের কিছু ধারণা-

১. হৃৎপিন্ড প্রদাহ শতকরা ৪০ থেকে ৮০ ভাগ বাচ্চার এটা হতে পারে। হৃৎপিন্ডের কম্পন বেড়ে যাওয়া এবং হৃৎপিন্ড বড় হয়ে যাওয়া, অনিয়মিত স্পন্দন বাড়তি হৃদকম্পন দেখেও ডাক্তাররা এটা নির্ণয় করতে পারেন।

২. শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর পায়ের-হাতের বড় বড় জয়েন্টে এই প্রদাহ থাকতে পারে। ফলে জয়েন্টগুলো ব্যথা করে ও ফুলে যায়। সাধারণত মাংসপেশিতে ব্যথা করে না।

তাই মনে রাখতে হবে, পায়ে ব্যথা কিংবা পায়ের মাংস ব্যথা হলেই বাতজ্বর এমনটি ঠিক নয়। ওপরে উল্লিখিত রোহানের এই পায়ে ব্যথার কারণ হলো ‘গ্রয়িং পেইন’ নামক সাধারণ একটি সমস্যা। ব্যথার নামটি ‘গ্রয়িং পেইন’ হলেও শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কেন শিশুরা এ ব্যথায় আক্রান্ত হয়, তার সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে শিশুর সারা দিনের দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি ও খেলাধুলাকে এজন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। সাধারণত ৩-৪ বছর বয়স থেকে শিশুর গ্রয়িং পেইন শুরু হয় এবং আট থেকে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত সে এই ব্যথা অনুভব করে। পরে ধীরে ধীরে ব্যথার মাত্রা কমে যায় বা ব্যথা আর হয় না। শিশুর গ্রয়িং পেইন তার দীর্ঘমেয়াদি কোনো ক্ষতি করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রয়িং পেইনের ব্যথা শিশুর ঊরুর সামনের বা পায়ের পেছনের মাংসপেশিতে হয়। কখনো কখনো হাতেও ব্যথা হতে পারে। তবে কখনই এই ব্যথা হাত-পায়ের কোনো গিরাকে আক্রমণ করে না। শিশুর গ্রয়িং পেইনের ব্যথা কমানোর জন্য তার পায়ের মাংসপেশির কিছু ব্যায়াম করতে হবে, পাশাপাশি হালকা গরম করে সেঁক দেওয়া যেতে পারে, তাই শিশুর পায়ে ব্যথা হলে অবহেলা না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিতে হবে।

লেখক :

বাত, ব্যথা, প্যারালাইসিস ও ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ

চেয়ারম্যান ও চিফ কনসালটেন্ট

ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist