ডা. মহসীন কবির
ডেঙ্গু থেকে সাবধানে থাকুন
এসেছে বর্ষাকাল। বর্ষার বৃষ্টি আমাদের স্বস্তি দিলেও এ সময় সারা দেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ অনেক বেড়ে যায়। কারণ ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজনন বাড়ানোর জন্য বৃষ্টির পানি খুবই কার্যকর। বৃষ্টিপাতের সময় এডিস মশার প্রজনন ও ডিম দেওয়া দুটিই বেড়ে যায়। আর এ কারণে বর্ষাকালে আমরা ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকি। এ ঋতুতে যদি আমরা কিছু সতর্কতা অবলম্বন করি, তবে থাকতে পারি ডেঙ্গুজ্বরের ঝুঁকিমুক্ত। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণু আমাদের দেহে প্রবেশ করে। জেনে রাখা ভালো, এ এডিস মশা সাধারণত ভোরে সূর্য ওঠার আধঘণ্টার মধ্যে ও সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের আধঘণ্টা আগে বেশি কামড়ায়। তাই এ ঋতুতে সকাল ও সন্ধ্যায় মশার কামড় থেকে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। সাবধান থাকার পাশাপাশি এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণই হচ্ছে ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের প্রধান উপায়। আর এ এডিস মশার প্রজনন কমানোর জন্য মশার ডিম পাড়ার সম্ভাব্য জায়গাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাসার আশপাশে ও কোনায় কোনায় যেখানে বৃষ্টির পানি জমতে পারে; এমনকি ঘরের ভেতরে ফুলের টব, পাতিল, ফ্রিজের নিচে, এসির নিচে এসব স্থানেও যেন চার থেকে পাঁচ দিনের বেশি পানি জমে না থাকে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া বাড়ির চারপাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ক্যান, টিনের কৌটা, মাটির পাত্র, বোতল, অব্যবহৃত গাড়ির টায়ারসহ পানি জমে থাকতে পারে এ ধরনের সব কিছুই প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে। যাদের দিনে ঘুমানোর অভ্যাস রয়েছে, তারা অবশ্যই মশারির ভেতর ঘুমাবেন। বাড়ির শিশুরা ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। তাই অবশ্যই তাদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে প্রয়োজনে তাদের ফুলহাতা জামা-কাপড় পরাতে হবে এবং মশার কামড়মুক্ত রাখতে হবে। শেষ কথা সর্বোপরি, এ বর্ষায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে আপনার ঘরকে যতটা যথা সম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও মশামুক্ত রাখুন। আসুন জেনে নিই ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণগুলো কী এবং এ জ্বরে আমাদের করণীয় কী-
ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ ও করণীয়
ডেঙ্গুজ্বর সাধারণ জ্বরের মতোই ভাইরাসজনিত একটি জ্বর। সাধারণত এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু ভাইরাস আমাদের দেহে প্রবেশ করে। তবে অন্য সব জ্বর, যেমন টাইফয়েড কিংবা সাধারণ জ্বরের সঙ্গে ডেঙ্গুজ্বরের মূল পার্থক্য হলো, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথম দিন থেকেই প্রচন্ড জ্বরে যেমন ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি জ্বরে ভুগে থাকেন। এ জ্বরে আক্রান্ত হলে রোগীর প্রচ- শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনের অংশে ব্যথা, পেটে ব্যথা, দেহের পেছনের অংশে ব্যথা অনুভূত হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর বমি হওয়া, খাওয়াতে অরুচিসহ শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত হতে পারে এবং সেই সঙ্গে শরীরে লাল চাকাসহ দাগ, দাঁত মাজার সময় রক্ত পড়া ও পায়খানার রং কালোও হতে পারে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে ভয়ের কিছু নেই, সাধারণ ভাইরাস জ্বরের মতোই এর চিকিৎসা। এজন্য আলাদা কোনো চিকিৎসা নেই। এমনকি চিকিৎসা না করলেও এমনিতেই ডেঙ্গুজ্বর ভালো হয়ে যায়। তবে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবশ্যই কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রোগীদের অ্যাসপিরিন অথবা অন্য কোনো জ্বরের বা ব্যথার ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো সাহায্য করে না। জ্বর কমানোর জন্য রোগী শুধু প্যারাসিটামল সেবন করতে পারে। ডেঙ্গুজ্বর হলে রোগীকে বেশি বেশি তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। যেমন- পানি, খাওয়ার স্যালাইন, স্যুপ, দুধ, তাজা ফলের রস ও শিশুদের মায়ের দুধ ইত্যাদি রোগীর জন্য পথ্যের মতো কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে আবার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে শরীরে অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে দেহে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। আর এ পানিশূন্যতায় কোষের ভেতরের তরল কমে যায়। এ কারণে কোষের চারপাশের রক্তনালিতে চাপ পড়ে। রক্তনালিতে চাপের কারণে দেহের ভেতর শুরু হয় ইন্টারনাল ব্লিডিং বা রক্তক্ষরণ। এজন্য রক্তের প্লেটলেট বা অণুচক্রিকা কমতে থাকে। এ অণুচক্রিকা কমার কারণে দেহে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। ফলে রক্তক্ষরণ আরো বাড়তে থাকে এবং রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। আর দেহে এভাবে প্লেটলেট কমতে থাকলে একসময় শক সিনড্রোমের কারণে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। তাই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের প্লেটলেটের মাত্রা জানতে হবে এবং প্রয়োজনে বাইরে থেকে রোগীর দেহে প্লেটলেট সরবরাহ করতে হবে। তবে জেনে রাখা ভালো, সঠিক চিকিৎসা পেলে ডেঙ্গুজ্বরে এখন রোগী মারা যায় না। তাই ডেঙ্গুজ্বর হলে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা নিন এবং সুস্থ থাকুন।
লেখক:
জনস্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক ও গবেষক
প্রিন্সিপাল, ইনস্টিটিউট অব জেরিয়েট্রিক মেডিসিন (আইজিএম)
প্রবীণ হাসপাতাল, আগারগাঁও, ঢাকা
"