মস্তিষ্কের টিউমার বা ক্যানসারের উৎপত্তি প্রধানত দুইটি উৎস থেকে। একটি হলো কলা বা কোষ থেকে উৎপন্ন ম্যালিগ্ন্যান্ট টিউমার, যা মস্তিষ্কে রক্ত সংবহন, লসিকাগ্রন্থি যেমন- সিএসএফের সাহায্যে মেট্যাস্ট্যাসিস বা দ্বৈতীয় হিসেবে আসে। দ্বিতীয়টি মস্তিষ্ক বা ব্রেইনের প্রাইমারি বা মস্তিষ্কের কোষকলা থেকে প্রত্যক্ষভাবে তৈরি প্রাথমিক টিউমার। মেট্যাস্ট্যাটিক ব্রেইন টিউমার প্রধানত আসে ছড়িয়ে পড়া ক্যানসার থেকে। যেমন- এর প্রধান উৎস হলো ফুসফুসের ক্যানসার, স্তন বা ব্রেস্ট ক্যান্সার, অন্ত্রের ক্যানসার, রক্ত ক্যান্সার বা লুকিমিয়্যা। প্রাইমারি ব্রেইন টিউমার সাধারণত মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোষকলা থেকে সৃষ্টি হয় এবং এর মধ্যে প্রধান ক্যানসারগুলো হচ্ছে- গাইয়োমা বা অ্যাস্ট্রোসাইটোমা, অলিগোডেন্ত্রোগ্লাইয়োমা, মেডুলোব্লাস্টোমা, ইপেন্ডাইমোমা ও লিম্ফোমা।

লক্ষণ : যেকোনো ব্রেইন টিউমার বা ক্যানসারের প্রধান লক্ষণ হলো মাথাব্যথা। এটা সাধারণত মস্তিষ্কের মধ্যে প্রেসার বৃদ্ধির কারণে হয়ে থাকে, যাকে বেশি ইন্ট্র্যাক্রেইনিয়্যাল প্রেসার বলা হয়। এই ব্যথার কারণ হলো ট্র্যাক্শন বা নড়াচড়া এবং ব্যথা বহনকারী স্নায়ুর উত্তেজনা। ব্রেইনের কোন স্থানে ক্যানসার সৃষ্টি হয়েছে, এর সঙ্গে মাথাব্যথার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সাধারণত মাথার পেছনে বা অক্সিপিটাল এলাকায় ক্যানসার বা টিউমার হলে মাথাব্যথা মাথার পেছনে এবং ঘাড়ে অনুভূত হবে।

খিঁচুনি : ব্রেইনের টিউমার বা ক্যানসারের আরেকটি প্রধান লক্ষণ হলো খিঁচুনি হওয়া। এই খিঁঁচুনি শরীরজুড়ে বা জেনার‌্যালাইজ্ড অথবা স্থানীয় কোনো অঙ্গে বা লোকালাই্ড হিসেবে প্রকাশ পায়, যদিও খিঁচুনি, অন্যান্য রোগ, যেমন- মৃগী বা এপিলেপ্সি, হাইড্রোকেফালাস, রক্ত জমা বা অন্য যেকোনো কারণে যখন মাথার মধ্যে ইন্ট্র্যাক্রেইনিয়্যাল প্রেসার বেড়ে গেলে হতে পারে।

ফোকাল ডেফিসিট : খিঁচুনির সঙ্গে ব্রেইনের কোন জায়গায় টিউমার বা ক্যানসার হয়েছে, তার লক্ষণ প্রকাশ পাবে। যেমন, ব্রেইনের ফ্রন্টাল লোব বা সামনের অংশে টিউমার বা ক্যান্সার হলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণগত পরিবর্তন; প্যারাইটাল লোবে টিউমার বা ক্যানসার হলে কথায় জড়তা, হিসাবে গরমিল; টেম্পোরাল লোবে ক্যান্সার বা টিউমার হলে কানে সমস্যা, গন্ধের সমস্যা এবং পেছনের দিকে বা অক্সিপিটাল লোবে টিউমার বা ক্যান্সার হলে দৃষ্টিশক্তির অসুবিধা হবে।

রোগ নির্ণয় : যত শিগগির সম্ভব নিউরোমেডিসিন বা নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখিয়ে নিচের রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষাগুলো করাতে হবে-

১. স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা দেখার জন্য ইলেক্ট্রোএন্কেফালোগ্রাফি (ইইজি)।

২. স্নায়ুতন্ত্রের পরিবহন ক্ষমতা বা নার্ভ কন্ডাক্শন টেস্ট বা ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাফি।

৩. রেডিওলজি বা ইমেজিং; যেমন- ব্রেইনের সিটিস্ক্যান এবং এমআরআই যেকোনো ধরনের ব্রেইনের রোগ নির্ণয়ের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট।

৪. সিটি গাইডেড এফএনএসি- যেকোনো টিউমার বা ক্যান্সার রোগ নির্ণয়ে অত্যন্ত নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা। এর সুবিধা হলো, রোগীকে অজ্ঞান করতে হয় না এবং একাধিকবার এই টেস্ট করা যাবে।

৫. স্টেরিওস্কোপিক বায়োপ্সি- নির্ভুল রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্রেইন টিউমার বা ক্যানসারে আক্রান্ত কোষকলার কিছু অংশ কেটে বের করে বিশেষ স্টেইনের মাধ্যমে মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করা।

৬. সিএসএফ বা সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুয়িড পরীক্ষা- লাম্বার পাংচার করে স্নায়ুরস বা সিএসএফ পরীক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি পরীক্ষা।

৭. রক্ত পরীক্ষা কিছু স্নায়ুতন্ত্রের অন্যান্য রোগ টিউমার বা ক্যানসার থেকে আলাদা করার জন্য প্রয়োজনীয়। যেমন- হাইপথিরয়্ডিজমের জন্য থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট, এসএলই সংযুক্ত স্ট্রোক, ভিটামিন বি১২ সংযুক্ত এটাক্সিয়া এবং সিফিলিসের জন্য ভিডিআরএল।

যদিও ব্রেইন টিউমার বা ক্যান্সারের লক্ষণগুলো দেরিতে প্রকাশ পায়, তবুও যেকোনো ধরনের বেশি ইন্ট্র্যাক্রেইনিয়্যাল প্রেশারের লক্ষণ, যেমন- মাথাব্যথা, দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া, খিঁচুনি, ফোকাল ডিফেক্ট, কথা বলায় জড়তা, হিসাবে গরমিল, স্ট্রোক, এক বা দুইদিকে অবশ হওয়া, গন্ধ শনাক্ত সমস্যা ইত্যাদি হলে সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এরপর ওপরে উল্লিখিত পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করে নির্দিষ্ট চিকিৎসা, যেমন ব্রেইন টিউমার অপসারণ, কেমো এবং রেডিওথেরাপি গ্রহণ বিশেষ করে ছড়িয়ে পড়া ক্যানসারের ক্ষেত্রে এসব রোগীর স্বাভাবিক এবং আরামদায়ক জীবনধারণের জন্য সহায়ক হবে। এ ব্যাপারে সবার, বিশেষ করে পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, প্যাথলজি বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল

"