নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ

বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে এনে দ্রুত বিচারের রায় কার্যকর করার দাবিসহ নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতি একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে। দিবসটি উপলক্ষে গতকাল ভোর থেকেই ঢাকার মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বদ্ধভূমি এলাকায় জনতার ঢল নামে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে সকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নেমেছিল। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই হাজারো মানুষ ভিড় করেন মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের সামনে। সবার হাতে ছিল ফুলের তোড়া ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে লেখা কালো ব্যানার।

বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে এসে শহীদ পরিবারের সন্তানরা বলেন, এবার আর আক্ষেপ নয়, পেছনে তাকানো নয়; এখন সময় এসেছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শহীদদের স্মরণ করতে আসা সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখছেন একটি আধুনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। তারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে এনে দ্রুত বিচারের রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন। ফুল দিতে আসা সর্বস্তরের জনতার মধ্যে অনেকে বলেন, বাংলাদেশ যে পথে হাঁটছে সময়ের ব্যবধানে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় বাধা ছিল। এখন সে বাধা দূর হয়েছে। দেশের প্রতি ত্যাগের মাধ্যমেই বড় হওয়া যায়, এটাই বুদ্ধিজীবীরা শিখিয়ে গেছেন।

১৯৭১ সালের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পরিকল্পিতভাবে দেশের কৃতী সন্তানদের হত্যা করে। তারপর থেকে দিনটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে গতকাল সকালে কালো পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা, শহীদদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বালন, শোক র‌্যালি, শ্রদ্ধা নিবেদন, চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞান, হাতের লেখা প্রতিযোগিতা ও মিলাদ ও দোয়া মাহফিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর রাষ্ট্রপতি সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। শহীদদের সম্মানে সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রাষ্ট্রপতি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশলবিনিময় করেন ও তাদের খোঁজখবর নেন।

পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মোজাফফর হোসেন পল্টু, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ড. আবদুর রাজ্জাক ও অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি ও জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও এ কে এম এনামুল হক শামীম, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক আসীম কুমার উকিল, উপদফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়–য়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এরপর জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। এ দেশে জঙ্গিবাদের স্থান নেই; তারা সফল হবে না।’ একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত পেলে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, জামায়াতের পরিকল্পনায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল। জামায়াত নিষিদ্ধের আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জামায়াত নিষিদ্ধে সব ধরনের প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে।

এ ছাড়া গতকাল সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গতকাল বেলা ১১টায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ঢাকার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণের পর সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান বিএনপি নেত্রী। এ সময়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

একে একে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানায় ১৪ দল, শহীদ পরিবারের সন্তান ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা, জাতীয় পার্টি, দলের সভাপতি রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, দলের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা।

এ ছাড়াও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, আওয়ামী যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, তাঁতি লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, শিশু একাডেমি, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানান। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

দিবসটি উপলক্ষে সকাল সাড়ে ১০টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ সাহানে কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নিহত সব শহীদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।

চট্টগ্রামে বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত : চট্টগ্রাম ব্যুরো কার্যালয় জানায়, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণা ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় নগর আওয়ামী লীগ, বিএনপি, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি, উদীচী, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন, মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন। এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠন কর্মসূচি পালন করেছে।

এর আগে বুধবার রাতে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে) সম্মিলিতভাবে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। বৃহস্পতিবার সকালে প্রেস ক্লাব ভবনের সামনে জাতীয় পতাকা ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রেস ক্লাব সভাপতি কলিম সরওয়ারের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশের সঞ্চালনায় বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার সকালে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিশ্চিত পরাজয় জেনে এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার পরিকল্পনা করে। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। সব রাজাকারের বিচার এখনো শেষ হয়নি। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

এ সময় নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, নঈম উদ্দিন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সুনীল কুমার সরকার, অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, খোরশেদ আলম সুজন, আলতাফ হোসেন বাচ্চু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ আবদুস ছালাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist