বিশেষ প্রতিনিধি

  ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭

আলোচনায় থেমে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি বা সম্মতিপত্র (অ্যারেঞ্জমেন্ট) স্বাক্ষর হয়েছে গত ২৩ নভেম্বর। সে স্মারক অনুযায়ী তিন সপ্তাহের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন ও দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু স্মারক স্বাক্ষরের পর গত দুই সপ্তাহের বেশি সময়েও জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে ন্যূনতম কোনো অগ্রগতি হয়নি। এমনকি ওই চুক্তি অনুযায়ী একই সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে খাদ্য, বাসস্থান ও নিরাপত্তাসহ সার্বিক ব্যবস্থার আয়োজন সম্পন্ন করার কথাও ছিল। কিন্তু সে ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলি বা টার্মস অব রেফারেন্স (টিওআর) সংবলিত খসড়াটি পর্যন্ত চূড়ান্ত করেনি মিয়ানমার।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো বলছে, চুক্তি অনুযায়ী জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি গঠন ও টিওআর চূড়ান্ত করতে মিয়ানমারকে দুই দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে টেলিফোনেও তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। এখনো আলোচনার পর্যায়েই রয়েছে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক ডাকা হবে। সেখানে করণীয় নির্ধারণ হবে। আমরা চাইছি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়ন হোক এবং এটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজরে থাকুক। সেভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বার্তা পাঠাচ্ছে ঢাকা। দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়নে এখন সর্বোচ্চ মনোযোগ বাংলাদেশের। এ ছাড়া এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেরও পর্যবেক্ষণ রয়েছে।

এদিকে চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চললেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন থেমে নেই। গত ২৩ নভেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। গত দুই সপ্তাহে নতুন করে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বৈশ্বিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারে উত্তেজনা কমলেও রোহিঙ্গাদের ওপর নানামুখী নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। ফলে গত মাসেই ২০ হাজারের বেশি এবং চলতি ডিসেম্বরে প্রথম দুই সপ্তাহে কয়েক শ রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। ফলে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। এখানে আগে থেকে আশ্রয়ে রয়েছে আরো প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলে ১০ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকের বাড়তি বোঝা বইতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

এর ফলে চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমারের সদিচ্ছা নিয়ে পুনরায় সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক চাপে নিজ দেশের নাগরিকদের ফেরাতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও এটির বাস্তবায়নে দেশটির আন্তরিকতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনে মিয়ানমার এক ধরনের চুক্তিতে যেতে বাধ্য হলেও সংকট সমাধান প্রলম্বিত করতে চাইবে। যাতে আন্তর্জাতিক নজর অন্যদিকে চলে যায়। ঢাকার কর্মকর্তারা অবশ্য বিষয়টির সঙ্গে লেগে আছেন। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক আহ্বানের কথাও জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফরেন ডেস্কের এক কর্মকর্তা বলেন, দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেই সবকিছু সমাধান হয়ে যাবেÑএমনটি মনে করেন না ঢাকার কর্মকর্তারা। যদিও চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক মহলের সম্পৃক্ততার প্রস্তাবে মিয়ানমারকে রাজি করানো যায়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ চাইছে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়ন হোক এবং এটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজরে থাকুক। সেভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বার্তা পাঠাচ্ছে ঢাকা। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়ে আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা চীনে যাচ্ছেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমারকে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি গঠন বা চুক্তির খসড়া তৈরিতে বাংলাদেশ কোনো সময়সীমার মধ্যে ফেলতে পারবে না। কারণ চুক্তিতে এ ব্যাপারে কিছু উল্লেখ নেই। যদিও তিন সপ্তাহের মধ্যে কমিটি গঠন ও দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসনের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সেটি মৌখিক। এমনকি চুক্তি অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত ঠিক কতজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়া হতে পারে ও চুক্তি বাস্তবায়নে কতদিন লাগতে পারে, সে ব্যাপারেও সংশয় রয়েছে। কারণ ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের পর ও গত ২৫ আগস্ট থেকে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা বলেছে মিয়ানমার। তবে মিয়ানমারে তারা বসবাস করত এ বিষয়টি তাদের প্রমাণ করতে হবে। আবার রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতি এখনো নিরাপদ বসবাসের সহায়ক নয়। ফলে একদিকে যেমন রোহিঙ্গারা যেতে রাজি হবে না, আবার গেলেও কিছুদিন পর পুনরায় ফেরত আসার আশঙ্কা রয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো এ কথাও বলে, মিয়ানমার থেকে পরিষ্কার করে এটাও বলা হয়নি, মিয়ানমারে ফিরলে রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে মূল বসতভিটায় ফিরতে দেওয়া হবে কি না। কৃষিজমি ফেরত দেওয়ার বিষয়টিও বলা হয়নি। সেই সঙ্গে দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যে বিশেষ ধরনের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং গ্রেফতার সংক্রান্ত মিয়ানমারের সতর্ক বার্তায় এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সমর্থক আছে উল্লেখ করে মিয়ানমার সরকার বলেছে, এমন কোনো ব্যক্তি ফিরে গেলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে। এর আগেও বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেওয়া রোহিঙ্গারা গ্রেফতার আতঙ্ক এড়াতে বাংলাদেশে দ্বিতীয় দফায় ফিরে এসেছে। বিশেষ করে চুক্তিতে তৃতীয় পক্ষ রাখতে রাজি না হওয়ায় মিয়ানমারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। চীনের বিরোধিতা ও প্রতিবেশী ভারতের আশানুরূপ সাড়া না মেলায় সহসাই এই সংকট সমাধানের আশা দেখছেন না তারা। তাদের মতে, কৌশলগত বিশ্ব রাজনীতির কারণে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়তে যাচ্ছে। এ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিতে গিয়ে শুধু চাপ সামালই নয়, এসব রোহিঙ্গার উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও আছে। আবার এদের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণের ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে উৎকণ্ঠা। কারণ যতটুকু মানবিক সহায়তার প্রয়োজন তার অর্ধেকের প্রতিশ্রুতিও পূরণ হয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করতে পারেÑজানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও রোহিঙ্গা গবেষক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, এখনো তিন সপ্তাহ শেষ হয়নি। আশা করছি এর মধ্যেই জয়েন্ট কমিটি গঠন হবে। শর্ত মেনে কত রোহিঙ্গা ফেরত যাবে, সেটি নিয়ে শঙ্কা আছে। তবে কিছু যাবে। গতকালও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বলছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার পরিবেশ বিরাজ করছে না। ফলে এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশ এমন এক জায়গায় আটকে আছে, যেখান থেকে বের হওয়া কঠিন। কারণ চীন সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। ভারতের আশানুরূপ সাড়াও পায়নি বাংলাদেশ। আবার এই দুই দেশের সঙ্গে নানা বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত। সুতরাং এদের বিপক্ষেও অবস্থান নিতে পারবে না।

এই বিশ্লেষক মনে করেনÑচীন, রাশিয়া, ভারতসহ ৮-১০টি দেশ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছে এবং মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চাপ দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই মিয়ানমার চুক্তিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু সে চুক্তি বাস্তবায়ন নির্ভর করবে এই চাপ কতটুকু বহাল থাকে, তার ওপর। আরেকটা চাপ না দিলে চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে বাধ্য করা যাবে না। চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শক্ত অবস্থান না নিলে বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়।

চুক্তি বাস্তবায়নে এখন বাংলাদেশের করণীয় কীÑজানতে চাইলে অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, বাংলাদেশের একমাত্র পথ হবে সংকট সমাধানে বিশ্বকে সরব রাখতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো। চুক্তির কিছু ধারা ভালো। যেমন বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা সেখানকার ঠিকানা বলতে পারলেই তাদের ফেরত নেওয়া হবে। তবে আন্তর্জাতিক চাপ না থাকলে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের পাঠাতে পারবে না। কারণ মিয়ানমার পরিকল্পিতভাবেই রোহিঙ্গামুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। অত সহজে সেখান থেকে পিছু হটবে না। ‘তবে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক চাপ দৃশ্যমান হতে হবে’ বলেও মন্তব্য করেন এই গবেষক। তার মতে, বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আরোপ করতে হবে। নির্বিচারে রোহিঙ্গা হত্যা, গণধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। তবেই মিয়ানমারকে বাধ্য করা যাবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist