গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৩ অক্টোবর, ২০১৭

স্মার্টকার্ড প্রকল্পে থাকছে বিশ্বব্যাংক

স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্টকার্ড) আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) প্রকল্পে থাকছে বিশ্বব্যাংক। চুক্তি থাকাবস্থায় মেয়াদ হালনাগাদ করে প্রকল্পে যুক্ত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে সংস্থাটি। কার্ড উৎপাদনে গতি বাড়ায় বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ শাখার সন্তোষ প্রকাশে এই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রশিক্ষিত ফ্রান্সের ওবার্র্থু টেকনোলজির উৎপাদনের সক্ষমতার চেয়ে তিনগুণ বেশি গতিতে উৎপাদন হচ্ছে স্মার্টকার্ড।

এ ছাড়া স্মার্টকার্ডে পরিণত হওয়ার আগে ব্লাককার্ডটিও এখন থেকে দেশেই উৎপাদিত হবে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। সম্পন্ন হয়েছে ‘ডেমো’ উপস্থাপন ও পর্যালোচনা। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) এই প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িত হয়েছে। অচিরেই ওবার্থুর মতোই ব্লাককার্ড সরবরাহে তারা সক্ষমতা দেখাবে বলে

আশা করা হচ্ছে। এদিকে চুক্তি লঙ্ঘনের কারণে ওবার্থুর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে সমঝোতা ও চিঠি চালাচালি অব্যাহত আছে। পাশাপাশি স্মার্টকার্ড মুদ্রণে ওবার্থুর ব্যর্থতার দায়ে ব্যাংক গ্যারান্টির ১২০ কোটি টাকা এবং কার্ডের ব্যয় সংকোচনে ৬০ কোটি টাকাসহ মোট প্রায় ২০০ কোটি টাকা সরকারের সাশ্রয় হচ্ছে।

জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ (এনআইডি) সূত্রমতে, ফ্রান্সের ওবার্থু টেকনোলজির সঙ্গে আইডিয়া প্রকল্পের সব ধরনের সম্পর্কের ইতি ঘটে গত ৩০ জুন তারিখে। মূলত দুটি কারণে এনআইডি উইং এবং সংস্থাটির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। কার্ড উৎপাদনে চুক্তির ন্যূনতম শর্ত পূরণে ওবার্থুর চরম ব্যর্থতা রয়েছে। দ্বিতীয় কারণ-দেশের নাগরিকদের সংরক্ষিত তথ্যভান্ডারে অনুপ্রবেশের অগণতান্ত্রিক চর্চার ধৃষ্টতা দেখানো। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন বিভাগের মহাপরিচালক ও আইডিয়া প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম সংস্থাটির চুক্তি হালনাগাদ করার বিষয়ে ওই দুটি কারণ অন্যতম বলে স্বীকার করেন।

জানা গেছে, চুক্তি বাতিল হওয়া ফ্রান্সের ওবার্থু কোম্পানি ৯ কোটি কার্ডের মধ্যে সরবরাহ করেছে ৭ কোটি ৭৩ লাখ ব্লাঙ্ক কার্ড। যার মধ্যে ১ কোটি ২৪ লাখ স্মার্টকার্ড পার্সোনালাইজেশন করে; যার হার ২ শতাংশ। এখন ব্লাঙ্ক কার্ডগুলো পার্সোনালাইজেশন করে ভোটারদের হাতে তুলে দিচ্ছে কমিশন। এ ছাড়া ব্লাককার্ড না থাকা ২ কোটি ৪৫ লাখ ভোটারকে বিএমটিএফের উৎপাদিত ‘ব্লাককার্ড’ পার্সোনালাইজেশন করে ধাপে ধাপে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে; এর জন্য ন্যূনতম এক-দেড় বছর সময় লাগতে পারে।

এদিকে গত বছরের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। পরদিন ৩ অক্টোবর থেকে রাজধানী ঢাকা ও বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীদের মাঝে কার্ড বিতরণ শুরু হয়। ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকার বিতরণ কার্যক্রম চলে। রাজধানীর বাইরে গত ১৬ মার্চ চট্টগ্রাম ও গত ২ এপ্রিল রাজশাহী মহানগরীতে কার্ড বিতরণ শুরু হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্য পাঁচটি বিভাগীয় শহরে বিতরণ চলছে। এখন একযোগে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কুমিল্লা, দিনাজপুর, নীলফামারীতে বিতরণ শুরু হয়েছে। আর বগুড়া জেলার কার্ড প্রস্তুতিও শেষ পর্যায়ে।

পারসু সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, ওবার্থুর তুলনায় তিনগুণ বেশি উৎপাদন বেড়েছে। নিজস্ব এবং ওবার্থুর উৎপাদনের তুলনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওবার্থুর প্রতিমাসে সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৭ লাখ এবং তারা চারটির বেশি মেশিন চালু রাখতে পারেনি। এদিকে গত ২৭ আগস্ট থেকে নিজস্ব উদ্যোগে ১০টি মেশিনে কার্ড মুদ্রণ শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রতিমাসে ৪৫ লাখ উৎপাদনের রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া কাজে সহায়তার জন্য আরো অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা চেয়ে সম্প্রতি সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের (পিএসও) কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

এনআইডির ডিজি ও আইডিয়া প্রকল্পের পরিচালক জানান, ওবার্থু কোনোদিন ১০টি মেশিন সচল রাখতে পারেনি, যা আমরা পেরেছি। পাশাপাশি তাদের মাসিক উৎপাদন ছিল সর্বোচ্চ ৭ লাখ এবং আমাদের ৪৫ লাখ।

সূত্রমতে, দেশীয় উদ্যোগে স্মার্টকার্ড উৎপাদনে কার্যক্রম হাতে নেওয়ার পর গত ১১ অক্টোবর বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশি মিশনের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভান্ডারে অবস্থিত পারসু (স্মার্টকার্ড উৎপাদন) সেন্টারে পরিদর্শনে যায়। পুরো টিমই বিস্ময় প্রকাশ করে উৎপাদনের গতি দেখে। কেন্দ্র পরিদর্শন করে দেশীয় উদ্যোগে এমন সাফল্যে নির্বাচন কমিশনের ভূয়সী প্রশংসা করে। পাশাপাশি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চুক্তি থাকলেও ওবার্থুর ব্যর্থতার কারণে প্রকল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার ছক ঠিক করলেও দেশীয় উদ্যোগে উৎপাদনের গতি দেখে চুক্তি নিয়মিত করতে উপায় খুঁজছে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের মে মাসে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে প্রায় ২০ কোটি ডলারের চুক্তি সই করে সরকার। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩৭৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) ঋণ ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে পাওয়া এ ঋণ বাংলাদেশকে ৪০ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম ১০ বছর কোনো সুদ দিতে হবে না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় এ প্রকল্পের অধীনে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে ৯ কোটি ভোটারের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেওয়ার কথা ছিল। পরে প্রকল্পের মেয়াদ দেড় বছর বাড়িয়ে চলতি ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত রয়েছে। স্মার্টকার্ড প্রস্তুত ও বিতরণের লক্ষ্যে ফ্রান্সের ওবার্থুর টেকনোলজিস নামে এক কোম্পানির সঙ্গে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার চুক্তি করে ইসি। ওই চুক্তির অধীনে নয় কোটি কার্ড উৎপাদন ও বিতরণের কথা ছিল। কয়েক দফায় পিছিয়ে সেই কার্ড বিতরণ শুরু হয় ২০১৬ সালে। পরবর্তীতে এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়েও সক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হয় ওবার্থু; যার চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্ক ছেদ। এখন নিজস্ব উদ্যোগে ও জিওবির অর্থায়নে স্মার্টকার্ড পাবেন ৯ কোটি ভোটার। পরবর্তী দেড় কোটি ভোটারকে নতুন প্রকল্পের অধীনে উন্নত প্রযুক্তির কার্ড দেবে নির্বাচন কমিশন।

এদিকে চুক্তির শর্তানুযায়ী স্মার্টকার্ড সরবরাহ ও বিতরণে ব্যর্থতার জন্য প্রকল্প থেকে সরিয়ে দেওয়া ওবার্থুর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে নির্বাচন কমিশন। রাষ্ট্রের সুনাম ক্ষুণœ করায় তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে চলছে চিঠি চালাচালি। এর জন্য বিশেষজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করা আছে। তবে ওবার্থু কোম্পানি বিলুপ্ত হয়ে নতুন আরেকটি কোম্পানি একত্রিত হওয়ায় কিছু কালক্ষেপণ হচ্ছে। তবে কমিশনের চিঠির জবাব অব্যাহত রেখেছে।

পাশাপাশি ওবার্থু চুক্তি অনুযায়ী কার্জটি সম্পন্ন করলে ব্যাংক গ্যারান্টির ১২০ কোটি টাকা মুনাফা করত, প্রকল্প শেষ না করায় এই টাকার পুরোটায় পাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। পাশাপাশি স্মার্টকার্ডের পাউসসহ অতিরিক্ত কিছু কাজ কাটছাঁট করায় আরো প্রায় ৬০ কোটি টাকার মতো সাশ্রয় হচ্ছে। এ হিসেবে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মতো সাশ্রয় হচ্ছে।

এনআইডির ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, ফ্রান্সের ওবার্থু প্রকল্প শেষ করলে তাদের মোট লভ্যাংশের সঙ্গে ব্যাংক গ্যারান্টির ১২০ কোটি টাকা যুক্ত হতো, প্রকল্প শেষ না করায় পুরো টাকাই সরকারের তহবিলে থেকে যাচ্ছে। পাশাপাশি স্মাটকার্ডের সঙ্গে একটি খাম, নির্দেশিকা ছাড়াও কার্ডের পাউস না রাখায় প্রায় আরো ৬০ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে, যা স্মার্টকার্ড প্রকল্পের পেছনে ব্যয় হবে। এ ছাড়া ওবার্থুর রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করায় তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist