কূটনৈতিক প্রতিবেদক

  ২৩ অক্টোবর, ২০১৭

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক

রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতেই হবে মিয়ানমারকে : সুষমা স্বরাজ

দুটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে ঢাকায় সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছেন, ‘রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফেরত নিতে হবে মিয়ানমারকে।’ রোহিঙ্গা নাম উচ্চারণ না করে শরণার্থীদের ফেরত নেওয়ার পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের শাস্তির কথাও বলেন সুষমা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা রাখার ওপর জোর দেন তাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠক থেকেও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেওয়ার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গতকাল অনুষ্ঠিত চতুর্থ যৌথ পরামর্শক কমিশনের বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকটে ভারতের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রাখাইনে স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। বৈঠক শেষে উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ দুই দিনের সফরে গতকাল ঢাকায় পৌঁছান। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুই দিনের সফরে রোববার সকালে ঢাকায় আসার পর সোনারগাঁওয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর সন্ধ্যায় গণভবনে যান সুষমা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর ব্যবহৃত কিছু সমরাস্ত্র প্রদর্শন অনুষ্ঠান হয়। বাংলাদেশকে শুভেচ্ছার স্মারক হিসেবে তখন ব্যবহৃত এমআই হেলিকপ্টার, দুটি ট্যাঙ্ক, ২৫টি বিভিন্ন অস্ত্র দিয়েছে ভারত। গণভবনের অনুষ্ঠানে ৩৮ ক্যালিবারের একটি সার্ভিস রিভলবার শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন সুষমা স্বরাজ।

বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে হবে।’ বিশাল সংখ্যার এই শরণার্থীদের বাংলাদেশের জন্য ‘বড় বোঝা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কতদিন এই ভার বহন করবে। এর একটা স্থায়ী সমাধান হতে হবে।’ বৈঠকে শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন সে দেশের পররাষ্ট্রসচিব জয়শঙ্কর এবং ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।

সুষমা স্বরাজ ঢাকায় আসার পর রোববার উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যৌথ কমিশনের বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জ্বালানি ক্রয় বিষয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। রোববার বিকেলে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। আর বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, ‘আমরা চাই নিরাপদে রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যাক। তবে সেখানে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রাখাইন এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। এই অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতও সহায়তা দিতে আগহী। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন দেখতে চায় ভারত।’ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের চ্যালেঞ্জগুলো একই। সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা ও উগ্রবাদিতা দুই দেশের মধ্যে সমান চ্যালেঞ্জ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নেওয়া জিরো টলারেন্স নীতির সঙ্গে আমরাও একমত হয়েছি।

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে ভারত যেন মিয়ানমারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে সে জন্য আমরা অনুরোধ জানিয়েছি। ভারত রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা দিয়ে আসছে, সে জন্য তাদের প্রতি আমরা বিশেষ কৃতজ্ঞ।’

মাহমুদ আলী বলেন, ‘ভারতের বিপক্ষে সন্ত্রাসী কাজে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ-ভারত প্রতিবেশী দেশ। দুই দেশই পরস্পরের বিশ্বস্ত বন্ধু। বৈঠকে সুষমা স্বরাজকে আবুল হাসান মাহমুদ আলী স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তার আমলেই তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হবে।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যৌথ কমিশনের বৈঠকে উভয় দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, নিরাপত্তা, অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহ, আন্তঃযোগাযোগ, সীমান্ত হাট, আঞ্চলিক যোগাযোগ, পর্যটন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি তোলা হয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের আরো জোরালো সমর্থন চেয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া বৈঠকে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর পারস্পারিক সফরে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নিয়ে পর্যালোচনা করেছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমিশন।

আজ সোমবার সকালে ভারতের অর্থায়নে বাস্তবায়িত ১৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন সুষমা স্বরাজ। ভারতীয় হাইকমিশনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও অংশ নেবেন তিনি। সুষমা স্বরাজ সোমবার সকালে ভারতীয় হাইকমিশনের নতুন চ্যান্সারি ভবন উদ্বোধন করবেন। সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও উপস্থিত থাকবেন। এরপর দুপুরে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন।

সুষমা স্বরাজের এই সফরের মধ্য দিয়ে গত এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের কোনো শীর্ষ মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলেন। এর আগে গত ৩ অক্টোবর ঢাকায় আসেন ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। ২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর শেষে চলতি বছর এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যেসব সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই হয়েছে, তার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেছেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একই সঙ্গে সহযোগিতার নতুন নতুন বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন তারা।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তৃতীয় যৌথ কমিশনের বৈঠক হয়েছিল। সে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অংশ নিয়েছিলেন।

দুটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই : যৌথ পরামর্শক কমিশনের বৈঠক শেষে উভয় দেশের মধ্যে দুটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিবিষয়ক ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও ভারতের নুমালিগড় রিফাইনি কোম্পানির মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়েছে। এ ছাড়া বৈঠক শেষে ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালাইন্সের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তিবিষয়ক একটি দলিল হস্তান্তর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist