নিজস্ব প্রতিবেদক
সীমানা পুনর্বিন্যাস ও সেনা মোতায়েনে আ’লীগের ‘না’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সর্বশেষ আদমশুমারির প্রতিবেদন প্রকাশ না করা পর্যন্ত ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস না করার প্রস্তাব দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) সহায়তায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ রয়েছে ইসিকে দেওয়া প্রস্তাবে। তবে, নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে দলটি। নির্বাচন ভবনে গতকাল বুধবার আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে ১১ দফা প্রস্তাব দিয়ে এসব মতামত তুলে ধরেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) খান মো. নুরুল হুদার সভাপতিত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অপরদিকে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ২১ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় জাতীয় পার্টি-জেপি এবং বিকেল ৩টায় এলডিপির সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইসির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সীমানা পুনর্বিন্যাস বিষয়টি জনসংখ্যা বিশেষ করে আদমশুমারির সঙ্গে সম্পর্কিত। সর্বশেষ ২০১১ সালে আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে (যা ২০১৩ সালে প্রকাশিত) ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। তাই নতুন আদমশুমারি ব্যতীত পুনরায় সীমানাবিন্যাস কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে বিভিন্ন আইনগত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।
এ ছাড়া আগামী বছরের অর্থাৎ ২০১৮ সালের শেষদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘৩০০ সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের মতো একটি জটিল কার্যক্রম সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে যেসব আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং খসড়া থেকে আপিল নিষ্পত্তি পর্যন্ত যে মহা কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে হয়, তা সময় স্বল্পতার কারণে বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না সে বিষয়টি ইসির বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক। কারণ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কমিশনের স্থানীয় সরকারের অনেকগুলো নির্বাচন রয়েছে।’ তাই সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করার আগে সবদিক ভেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য ইসির প্রতিরোধ জানিয়েছে দলটি।
আর ইভিএম বিষয়ে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের ন্যায় আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের সহায়তায় ভোটদানের প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।
তবে, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে সতর্ক প্রস্তাব রেখেছে দলটি। বলা হয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর হতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন এবং নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের জন্য প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ন্যস্ত থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য নির্বাচনের কাজে যুক্ত করা যাবে, তা ১৮৯৮ সালের প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধিতে উল্লেখ রয়েছে। এই কার্যবিধির ১২৯-১৩১ ধারায় এবং সেনা বিধিমালায় ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ শিরোনামে স্পষ্ট করা আছে বলে দলের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ইংরেজি ভাষায় প্রণীত গণ-প্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) বর্তমান কমিশন বাংলায় প্রণয়ন করলে ক্ষমতাসীন দল তাতে আপত্তি করবে না। এতে আওয়ামী লীগের সমর্থন থাকবে। প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, নির্বাচনে অবৈধ অর্থ এবং পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধে সংবিধানে প্রণীত নির্বাচনসংক্রান্ত নির্দেশনা এবং বিদ্যমান নির্বাচনী আইন ও বিধিমালা নিরপেক্ষ ও কঠোরভাবে প্রয়োগ, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত এবং নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার অপেশাদার ও দায়িত্বহীন আচরণের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ, নির্বাচন পরিচালানায় কেবল প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল কর্মচারীদের মধ্য থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার পদে নিয়োগ করা, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী প্রার্থীদের বাছাই করে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী চূড়ান্ত করা, নির্বাচনে পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা এবং কোনোভাবেই বিশেষ দল বা ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যশীল হিসেবে পরিচিত বা চিহ্নিত ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দায়িত্ব প্রদান না করা, নির্বাচনের দিন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ সব গণমাধ্যমে কর্মীদের নির্বাচনী বিধিবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে দায়িত্ব পালনের জন্য কার্যকরী নির্দেশ প্রদান এবং গণমাধ্যমকর্মীদের উপযুক্ত পরিচয়পত্র প্রদান বা তাদের দায়িত্ব কর্ম এলাকা নির্ধারণ করা এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়োজিত পোলিং এজেন্টদের তালিকা ছবিসহ কমপক্ষে তিন দিন আগে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে প্রদান নিশ্চিত করা ও প্রিসাইডিং অফিসার তাদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ভোটকক্ষে প্রবেশ ও নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থানের অনুমতি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা।
এদিকে, সংলাপ থেকে বেরিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ১১ দফা প্রস্তাব কমিশনের কাছে উপস্থাপন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ভোটে ইভিএম চালু করা, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বাংলায় করার উদ্যোগে সমর্থন, নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধে সংবিধানে বর্ণিত নির্বাচনসংক্রান্ত নির্দেশনা এবং বিদ্যমান নির্বাচনী আইন ও বিধিমালা নিরপেক্ষ ও কঠোর প্রয়োগ, তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই এবং নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্র্নিধারণ না করা।
এর আগে গত রোববার বিএনপির সঙ্গে সংলাপে সিইসি বলেছিলেন, ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপি ভালো ভালো কাজ করেছে। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ তার ব্যাখ্যা পেয়েছে। কিন্তু তা তারা বলতে চায় না।
সংলাপে আওয়ামী লীগ তাদের প্রস্তাবনায় দলটির ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বিএনপি রাজনৈতিক সংস্কৃতি তুলে ধরে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে বিএনপির ক্ষমতায় টিকে থাকতে কী ধরনের কর্মকা- করেছিল তার ফিরিস্তি তুলে ধরেন। সেখানে ঢাকার মিরপুর ও তেজগাঁ, মাগুরার উপনির্বাচন এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির দলবিহীন নির্বাচনের বর্ণনা দেন। দলটির শাসনামলে নজিরবিহীন কারচুপি ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় বলে অভিহিত করা হয়। পরে ২০০১ সালে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় এসে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল, সেই ইতিহাসও তুলে ধরা হয়।
প্রতিনিধিদলে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেনÑআমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, এইচটি ইমাম, ড. মসিউর রহমান, ড. মো. আবদুুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, রমেশ চন্দ্র সেন, অ্যাম্বাসেডর জমির, মো. রশিদুল আলম. মাহবুব-উল-আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুুর রহমান, এইচ এন আশিকুর রহমান, ড. হাছান মাহমুদ, ড. আবদুুস সোবহান গোলাপ ও অ্যাডভোকেট এবিএম রিয়াজুল কবির কাওছার।
"