প্রতীক ইজাজ

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বিশ্লেষকদের অভিমত

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সমাধানের পথ দেখাবে

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিঃশর্তে ও অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে গতকালের ওই ভাষণে শরণার্থীদের ফেরত নিয়ে তাদের সুরক্ষা দিয়ে পুনর্বাসনের কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে এই অধিবেশনেই ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে নির্যাতন বন্ধ করে তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়া এবং তাদের জাতীয়তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় অপপ্রচার বন্ধ করাসহ ছয়টি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন প্রধানমন্ত্রী।

বিশেষ করে গতকাল দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো প্রশংসা করে তার ভাষণকে যেমন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে; তেমনি তার ওই ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে বলেও মনে করছে তারা। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে ‘কার্যকর’ ও ‘সময় উপযোগী’ বলে মনে করছেন দেশের কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এবং শরণার্থী গবেষকরা। তাদের মতে, এই ভাষণের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একটি সুস্পষ্ট কৌশল পেল। এখন তাদের উচিত হবে এই কৌশল ধরে সমস্যার সমাধান করা। প্রধানমন্ত্রীর উত্থাপিত এই কৌশল মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের সামগ্রিক নিরাপত্তার পথে যেতেও সাহায্য করবে বলেও মনে করছেন তারা। বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তার মাধ্যমে মিয়ানমারকে জাতিগত নিধন ও গণহত্যার অপরাধে আন্তর্জাতিক আদালতে শাস্তি পেতেও সাহায্য করবে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি কাড়তে সমর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। আট লক্ষাধিক শরণার্থীর আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে জাতিসংঘেও সবার মনোযোগের কেন্দ্রে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পাশাপাশি জাতিসংঘ মহাসচিবও মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন। সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেওয়ার আগেই জাতিসংঘে বিভিন্ন বৈঠক ও সভায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দফতরে ওআইসি কনটাক্ট গ্রুপের বৈঠকে তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে তার প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি জোরের সঙ্গে বলেন, এই শরণার্থীদের মিয়ানমারকে ফেরত নিতেই হবে। এরপর বিশ্ব সংস্থার সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের সামনে গতকাল বাংলায় দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরেন।

এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্বকে এক কাতারে এনে দাঁড় করানোর জন্য সাধারণ পরিষদের অধিবেশনটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রতিনিধিরা সেখানে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু রোহিঙ্গা সংকটের কথাই শুধু তুলে ধরেননি, বিষয়টি সুস্পষ্টও করেছেন। এখন দেশগুলো এ নিয়ে আলোচনা করে সমাধানের পথে এগোতে পারবে। এই মতামতের পক্ষে অবস্থান নেওয়া দেশগুলোর জন্য সহজ হবে। শেখ হাসিনা একটি সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা উত্থাপন করেছেন। এত দিন ধরে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যে বিচ্ছিন্ন চিন্তাভাবনা ছিল বিশ্বজুড়ে, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সেই বিক্ষিপ্ত চিন্তাকে একটি সুসমন্বিত চিন্তার কৌশলে রূপ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বকে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন করতে পেরেছেন।

এখন জাতিসংঘের দায়িত্ব কী হবে-জানতে চাইলে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, একটি সম্মিলিত প্রস্তাব পাস করতে পারে। সেটি নিরাপত্তা পরিষদকে দিয়ে কার্যকর করতে হবে। তবে এর জন্য নিরাপত্তা পরিষদ রুদ্ধদ্বার বৈঠক না ডেকে উন্মুক্ত অধিবেশন আহ্বান করতে পারে। অবশ্য নিরাপত্তা পরিষদে এই প্রস্তাব পাস হওয়া কঠিন। কারণ সেখানে দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। তারা চাইছে জাতিসংঘের মাধ্যমে না গিয়ে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু বাংলাদেশ হাঁটছে জাতিসংঘকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণের। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ আশা করছি সমাধানের পথ দেখাবে।

এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের অভিযোগ উঠেছে। এসব খতিয়ে দেখতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন একটি ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি করেছে। মিয়ানমার সে কমিটিকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। প্রধানমন্ত্রীও অনুসন্ধানী দল গঠন করে তদন্ত করতে বলেছেন। তিনি আশু প্রত্যাবাসনের পক্ষে। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বকে রোহিঙ্গা সংকটের মূল বিষয় বোঝাতে পেরেছেন। এটি বড় অর্জন। এই প্রবাহ সমস্যার সমাধান করবে।

‘এই ভাষণের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যা সমধানের কৌশল দিয়েছেন’-উল্লেখ করে আবদুর রশিদ বলেন, এখন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা সে কৌশল ধরে সংকট সমাধানের পথে যেতে পারে। মিয়ানমারকে সতর্ক করতে হবে। এত দিন মিয়ানমার তাদের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অবরোধ সহ্য করতে পেরেছে। এখন সে পরিস্থিতি নেই। তখন বিচ্ছিন্ন ছিল তারা। এখন বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিকভাবে তারা বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। শান্তিপূর্ণ অবস্থান দরকার। মিয়ানমারকে অবশ্যই অবনত হতে হবে।

মিয়ানমারের সাবেক কূটনীতিক মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ কুমার চাকমা বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে আমাদের মনে কথাই বলেছেন। আশাবাদী এই জন্য যে, তিনি যেসব কর্মপন্থা উত্থাপন করেছেন তা অনুসরণ করলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান সহজ হবে। প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে বলেছেন। জাতিসংঘের উচিত হবে পাঠানো। এর আগে অং সান সুচিও অনুরূপ দলকে আহ্বান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। সু চিও সে প্রতিবেদন বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন। এটি হলে সব সমস্যার সমাধান হবে। কারণ সেখানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা আছে। নাগরিক হলে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনও সহজ হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য যে নিরাপদ অঞ্চল করার কথা বলেছেন, সেটিও ওই নাগরিকত্বের সঙ্গেই যুক্ত।

‘প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণের মধ্যে দুই রাষ্ট্রই (মিয়ানমার ও বাংলাদেশ) রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চান, তা রয়েছে’-উল্লেখ করে এই সাবেক কূটনীতিক বলেন, ভাষণে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দুই দেশের ইঙ্গিত প্রকাশ পেয়েছে। এটাকে ধরেই এগোতে হবে। কূটনৈতিক রাজনীতি চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিকভাবেও সমাধানের পথে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবগুলো বাস্তবমুখী ও প্রজ্ঞাময়। আশা করছি বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিবেচনা করবে। যে প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী করেছেন, তাতে সমস্যার মূল বিষয়গুলো রয়েছে। এ কৌশলে এগোলে বাধাও দূর হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও রোহিঙ্গা গবেষক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী সময়োপযোগী ও কার্যকর ভাষণ দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন। মিয়ানমারের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে পেরেছেন। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে ঔদার্য দেখিয়েছে, সেটি তুলে ধরতে পেরেছেন। অন্যদিকে, সীমান্তে মাইন পুঁতে রেখে মিয়ানমার যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায় না, সেটিও বিশ্বকে বোঝাতে পেরেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সমস্যার সমাধানের কোনো চরমপন্থার আশ্রয় নেননি। সহজ সমাধানের পথ দেখিয়েছেন। মিয়ানমার যেভাবে আহ্বান করেছে, প্রধানমন্ত্রীও জাতিসংঘকে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি করে মিয়ানমারে অনুসন্ধান চালাতে বলেছে। গণহত্যার তদন্ত করতে বলেছেন। এমনকি এই জাতিগত নিধনের জন্য যে মিয়ানমারের বিচার হওয়া উচিত, সে কৌশলের কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ অনুসন্ধান দল গেলেই মিয়ানমারের গণহত্যার প্রমাণ পাবে। শুধু রোহিঙ্গাদের ফেরত নিলেই হবে না। তাদের জন্য নিরাপদ বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। পুনর্বাসন করতে হবে। সে কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সামগ্রিক সমাধানের পথ দেখিয়েছেন।

‘আমরা আশাবাদী’-উল্লেখ করে এই গবেষক বলেন, কারণ প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচকভাবে সংবেদনশীল থেকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের কৌশল উত্থাপন করতে পেরেছেন। এত দিন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ সংকট সমাধানে যতটুকু সক্রিয় ছিল, এখন তার চেয়ে বেশি উদ্যোগী হবে। তাদের বোঝাতে পেরেছেন, যতটা ভাবা হচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের মাত্রা তার চেয়েও ভয়াবহ। এই সংকট যে কেবল বাংলাদেশেরই নয়, এটি যে আঞ্চলিক শান্তিও বিঘ্নিত করতে পারে, প্রধানমন্ত্রী এবার অধিবেশনে সেটি বোঝাতে পেরেছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist