প্রতীক ইজাজ

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

রোহিঙ্গা নিধন

নেপথ্যে ৪ সেনা কর্মকর্তা ও ১ বৌদ্ধ ধর্মগুরু

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। দেশটির ভেতর রোহিঙ্গা নিধন ও নির্যাতনযজ্ঞ বন্ধ করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে দেশটির ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের প্রস্তাবও উঠেছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন বন্ধে দেশে দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে।

সর্বশেষ চলমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনেও রোহিঙ্গা ইস্যুটিই সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। স্বয়ং সংস্থা রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ বন্ধ করতে শুরু থেকেই আহ্বান জানিয়ে আসছে। এমনকি দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিকে গত বুধবার দেওয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণের আগের দিন রোহিঙ্গা নিধন বন্ধের জন্য উদ্যোগ নিতে ‘এখনই শেষ সুযোগ’ এবং তা ‘না হলে এই ট্র্যাজেডি হবে সত্যিই ভয়ংকর’ বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়। বিশেষ করে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী বাংলাদেশ বেশি সোচ্চার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ব্যাপারে। কারণ ইতোমধ্যেই সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্যরে এই দেশে চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। তাদের রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে রোহিঙ্গা বিষয়ে ওআইসির কনটাক্ট গ্রুপ সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই’ ওআইসিভুক্ত দেশগুলোকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, সংকটের মূল মিয়ানমারে। এর সমাধানও মিয়ানমারকেই খুঁজে বের করতে হবে। আমরা এই জাতিগত নিধনের শেষ চাই।

কিন্তু এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নিধনযজ্ঞ বন্ধ করে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারকে বাধ্য করানো যায়নি। এমনকি নিধনযজ্ঞের কথা স্বীকারও করছে না দেশটি। বরং উল্টো সে দেশের নাগরিকদের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির সেনাপ্রধান। সর্বশেষ বিশ্ব জনমত ও আহ্বানকে উপেক্ষা করে অং সান সু চিও তার ভাষণের মধ্য দিয়ে পক্ষান্তরে সে দেশের সেনাবাহিনীর পক্ষই নিয়েছেন বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো জাতিগত নিধনযজ্ঞের জন্য মিয়ানমারকে শাস্তির আওতায় আনার দাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় কূটনৈতিক মহল এবং মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, কেবল উদ্বেগ ও নিন্দাই নয়, রোহিঙ্গা নিধনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করায় মিয়ানমারকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। বিশেষ করে এই হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের নেতৃত্বদানকারী ও সরাসরি জড়িতদের বিচার হতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে।

এ ব্যাপারে মিয়ানমারের সাবেক কূটনীতিক মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা গণহত্যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিচার সম্ভব। এ ধরনের গণহত্যার বিচারের জন্য বিশ্বে একটি স্থায়ী আদালত সৃষ্টি করা হয়েছে। ১৯৯৮ এর অনুচ্ছেদ ১৩ অনুযায়ী আইসিসিতে বিচার করা সম্ভব। নিরাপত্তা কাউন্সিল রেজুলেশন পাস কোনো বিষয়কে যদি রেফার করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) এ বিচারের জন্য পাঠায়; সে ক্ষেত্রে বিচার করা সম্ভব। তবে অং সান সু চি মূলত ক্ষমতাহীন। মূল ক্ষমতা সেনাপ্রধানের হাতে। সেনাপ্রধান একটি জাতির বিরুদ্ধে আরেকটি জাতিকে লেলিয়ে দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।

বার্মায় চলমান হত্যাযজ্ঞকে বর্বরোচিত আখ্যা দিয়ে এই সাবেক কূটনীতিক বলেন, এ জন্য মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমারের বিচারের দাবি তোলা উচিত। ধারণা করা হচ্ছে, দেশটিতে এ পর্যন্ত মারা গেছেন পাঁচ হাজার মানুষ। ফলে মিয়ানমারকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।

‘তবে এর জন্য প্রথমে প্রমাণ করতে হবে যে, সেখানে (মিয়ানমারে) মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে’-বলে মন্তব্য করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ। তিনি বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক সর্বোচ্চ কমিটি হিউম্যান রাইটস কমিশনের পক্ষে ইতোমধ্যে মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের তদন্তের জন্য ফ্যাক্টস ফাউন্ডিং কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনে যদি বলা হয়, এই হত্যাযজ্ঞে দায়ীদের বিচার হোক-তাহলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) বিচার করতে পারে। আইসিসি নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে অনুসন্ধান করে মামলা নিয়ে এসে মিয়ানমারের গণহত্যার বিচার করা যেতে পারে। এ ছাড়া যে দেশে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেই দেশের সরকার অনুরোধ করলেও আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গাদের নির্মূল করতে গিয়ে মিয়ানমারের সামরিক ও বর্ডার পুলিশ বাহিনী এবং রাখাইন অঞ্চলের বৌদ্ধ চরমপন্থিরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নৃশংস অভিযান চালিয়েছে। নারীদের ধর্ষণ করেছে। বাড়ি-গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। শিশুদের ওপর নির্যাতনের খবরও এসেছে। বহু দেশ ও মানবাধিকার সংগঠন মিয়ানমার সেনাশাসকদের অভিযানকে ‘হত্যাযজ্ঞ’ ও ‘এথনিক ক্লিঞ্জিং’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনও শক্ত ভাষায় একে ‘গণহত্যা’ বলেছে। প্রাণ বাঁচাতে গতকাল পর্যন্ত চার লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের ৬০ শতাংশই শিশু।

তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যার পেছনে সে দেশের চার সেনা কর্মকর্তা ও এক বৌদ্ধ ধর্মগুরুকে দায়ী করেছেন। তাদের মতে, অং সান সু চিও এর দায় এড়াতে পারেন না। কারণ এখন পর্যন্ত তিনি রোহিঙ্গা নিধনের বিপক্ষে অবস্থান না নিয়ে উল্টো সে দেশের সরকারকে সমর্থন করছেন। তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সেনাবাহিনীর সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সমঝোতায় যাওয়ার খবরও এসেছে। সু চি ২০১৬ সালের মে মাসে আমেরিকাকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটা না ব্যবহারের অনুরোধ করেন। এতে নাকি দেশটির জন্য জাতীয় ঐক্যমতের পথে হাঁটা কঠিন হয়ে পড়ে। মিয়ানমারের সেনাশাসকও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করছেন না। সু চিও তার ভাষণে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার করেননি।

এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ১ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর প্রধান ঘোষণা দেন যে, এবার তারা যা করেছে, অতীতের সরকার পারেনি। সরকার ‘বাঙালি’ প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধান করবে। দুঃখজনক হলেও গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে কথিত অং সান সু চিও প্রায় একইভাবে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অং সান সু চি আরসার আক্রমণকে ‘জঙ্গি’ আখ্যায়িত করেছেন। অথচ রোহিঙ্গাসহ এসব জাতিগোষ্ঠী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় জেনারেল অং সান সু চির নেতৃত্বে জাপান বাহিনীর সহায়ক হিসেবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। সেই রোহিঙ্গা নিধনে সু চি পক্ষান্তরে সেনা সরকারকেই সমর্থন করছেন। তাই সু চিকেও দায়ভার নিতে হবে।

গবেষকদের মতে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নির্মূল করার দায়িত্বে রয়েছেন সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিন অং হায়াং এবং তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের তিন জেনারেল এবং বৌদ্ধ ধর্মগুরু অসিন উইরাথু। এই গুরুত্বপূর্ণ তিন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ এবং পরিচালনায় রয়েছেন সামরিক বাহিনীর প্রধান বা সর্বাধিনায়ক। এসব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল কায়ান সু, সীমান্ত মন্ত্রণালয়ের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়ে অং ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেইন ওইন। এই চার সেনা কর্মকর্তাই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কথিত রূপকার।

গবেষকরা জানান, এই নৃশংস অপরাধের জন্য দায়ী আসল ব্যক্তি এই সেনাপ্রধানই। তিনিই মূলত সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন। দেশটিতে সংস্কার শুরু হওয়ার আগে মিন অং হায়াংয়ের সেনাবাহিনী ঘরোয়া বিভিন্ন সংঘাতে যুক্ত ছিল। কাচিন ও শান রাজ্যে তার সেনাবাহিনী প্রচুর বেসামরিক মানুষ মেরেছে। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জাতিসংঘ তদন্ত চালাচ্ছে। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে প্রধান বাধা তিনিই। অথচ এই সেনাপ্রধানের গত বছর চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও আরো পাঁচ বছর, অর্থাৎ ২০২০ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। এমনকি ২০২০ সালের নির্বাচনে তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে।

অভিযুক্ত ধর্মগুরুর প্রসঙ্গে গবেষকরা বলছেন, এই সামরিক গোষ্ঠীর পেছনে রয়েছেন কট্টরপন্থি বৌদ্ধ ধর্মগুরু অসিন উইরাথু। টাইম ম্যাগাজিন-এর প্রচ্ছদে তার ছবির ওপরে শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল ‘সন্ত্রাসের মুখ’। এই বৌদ্ধ ধর্মগুরু মুসলমান, বিশেষ করে রোহিঙ্গাবিরোধী এবং এদের নির্মূল করতে তার অনুসারীদের মাঠে নামিয়েছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কের সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে তার বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান নিশ্চিত করা। কাজেই রোহিঙ্গা নিধন এবং গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চার জেনারেল এবং এক ধর্মগুরুই দায়ী থাকবেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রোহিঙ্গা,মিয়ানমার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist