প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

‘মিথ্যাচারে ইতিহাস পাল্টাতে চাইছেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান’

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের মধ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব অস্বীকার করে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের বক্তব্য ‘মিথ্যাচারের মাধ্যমে ইতিহাস পাল্টানোর’ প্রয়াস হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের রাজনীতিক ও গবেষকরা। ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা আসার আগেই কী করে তৎকালীন বার্মার আরাকান (বর্তমানে রাখাইন) রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল, তা দেখিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলছেন, তাদের অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই মিয়ানমারের।

রাখাইনে যে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা নির্যাতন চলছে, জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর বক্তব্যে তার প্রমাণ দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন। রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করার মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের প্রয়াসের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা। তার বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক এক সেনাপ্রধান। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের এই সংকট সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশের সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা।

অর্ধশতক সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করলেও দেশটি এখনো কার্যত সেনাবাহিনীই চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং শনিবার ইয়াঙ্গুনে এক অনুষ্ঠানে বলেন, রোহিঙ্গা বলে কোনো জাতিসত্তা তার দেশে ‘কখনোই ছিল না’। যারা নিজেদের রোহিঙ্গা বলছে, তারা আসলে ‘বাঙালি চরমপন্থি’।

‘রোহিঙ্গাদের উৎস ও বিকাশ’ শীর্ষক নিজের এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আরাকানের আরবি হরফে লেখা মুদ্রার সন্ধান আমরা পেয়েছি। তাই ঢালাওভাবে তাদেরকে বাঙালি বলার ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই।’

রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে বার্মার সঙ্গে যুক্ত করার আগে ১৪০৪ সাল থেকে ১৬২২ সাল পর্যন্ত ১৬ জন মুসলিম রাজা আরাকান শাসন করেন। ওই সময়ে সীমান্ত প্রথা না থাকায় কবি-সাহিত্যিকসহ সাধারণ মানুষের বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়া ও বসতি গড়ার উদাহরণ হিসেবে মধ্যযুগের খ্যাতনামা বাঙালি কবি আলাওলকে উদাহরণ টানেন অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। মহাকবি আলাওল বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা। তিনি তো আরাকানের সভাকবি হয়ে গিয়েছিলেন। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও মানুষজন আরাকানে গিয়েছিল। এটা হচ্ছে জাতি হিসেবে রোহিঙ্গাদের উদ্ভবের ইতিহাস।

ব্রিটিশদের ১০০ বছরের শাসনের একপর্যায়ে আরাকান রাজ্যসহ বার্মা ভারতবর্ষের অধীন হয়। তখনো ভারত-বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষের যাতায়াত ছিল রেঙ্গুন (বর্তমান ইয়াঙ্গুন) পর্যন্ত।

আরাকানে বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার আরাকান ছেড়ে চট্টগ্রামে আশ্রয় নেওয়ার কথা আছে বাংলাপিডিয়ায়। বার্মার স্বাধীনতার পর অন্য সব জাতিগোষ্ঠীর মতো রোহিঙ্গারাও একটি জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান নেই উইন ক্ষমতা দখলের পর শুরু হয় রোহিঙ্গা নিপীড়ন।

তার ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালে নতুন নাগরিকত্ব আইনে অন্য জাতিগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও বাদ দেওয়া হয় রোহিঙ্গাদের; তারা হয়ে পড়েন মিয়ানমার রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্রহীন নাগরিক। তখন থেকে এ রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চালাতে চাইছে মিয়ানমারের জান্তারা। এর প্রতিবাদ জানিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ১৯৮২ সালের বার্মার নাগরিকত্ব আইন জারির পর রোহিঙ্গাদের তাদের সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

এবার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা নির্যাতনকে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান হিসেবে দেখছে জাতিসংঘ। বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের নিন্দা জানাচ্ছে। দেশটির ওপর অবরোধ আরোপের হুমকি দিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অস্ত্র কেনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি তুলেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

এরই মধ্যে মিয়ানমারের জেনারেলের বক্তব্য ‘সর্বোচ্চ পদে বসে নিপীড়নের ইন্ধন’ বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক দেলোয়ার। বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান নিধন, হত্যাযজ্ঞ যে রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্গানাইজড ওয়েতে হচ্ছে, মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের বক্তব্য তাই প্রমাণ করে।

অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের একটা ইতিহাস তৈরি করেছে। অথচ বার্মা রাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার আগ থেকেই রোহিঙ্গারা সেখানে অবস্থান করছিল বলে প্রমাণিত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক মিয়ানমার সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে ‘চরম অন্যায়’ আখ্যায়িত করে রোহিঙ্গাদের ইতোপূর্বে মিয়ানমারের নানা পদে আসীন থাকার কথা বলেন। তিনি বলেন, এই রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে অনেকেই মিয়ানমার সরকারে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সুতরাং এই রোহিঙ্গারা অবশ্যই মিয়ানমারের বাসিন্দা। মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ অনেকেই তাদের স্বীকার করছেন না, এটা চরম অন্যায়, মোটেই ঠিক না।

রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে মিয়ানমারের অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান। বাংলাদেশের সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের বক্তব্যে তিনি যারপরনাই অবাক হয়েছেন। আমি তার বক্তব্য পড়েছি, সামরিক জান্তা বলছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা বলে কিছু নেই; এরা বহিরাগত, বাংলাদেশের মানুষ। তার বক্তব্য বিভ্রান্তিকর; আমার তো অবাক লাগল।’

জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের মতে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বক্তব্য এক কথায় ‘একেবারেই অযৌক্তিক, ভ্রান্ত এবং দুঃজনক’। তিনি বলেন, একটা জাতিগোষ্ঠী ৫০০-৭০০ বছর ধরে একটা দেশে বসবাস করছে; সেখানে তিনি বলে দিলেন, এ রকম জাতিসত্তা মিয়ানমারে কখনোই ছিল না! রোহিঙ্গা সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধান মিয়ানমারের কাছে প্রত্যাশা করেন সাবেক এই মন্ত্রী। রাজনীতিকদের মতো সাবেক কূটনীতিকসহ বাংলাদেশের অন্যরাও মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের বক্তব্যে নিন্দা জানাচ্ছেন।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, বললেই তো হয় না... রোহিঙ্গারা এক সময় নাগরিক ছিল, তাদেরকে ইচ্ছে করে নাগরিকত্ব বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তারা মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে, স্বাধীনতার পরেও নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছিল, সে দেশে সংসদেও প্রতিনিধিত্ব করেছে। তাদের শাসকচক্র সুবিধার জন্য, সস্তা রাজনীতির জন্য নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বৈরাচারী সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে এর চেয়ে ভালো কিছু হয়তো বিশ্ববাসী আশা করে না। তবে এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি মূর্খতার পরিচয় দিয়েছেন।

মিয়ানমার সেনাপ্রধানের ওই বক্তব্যের পর বাংলাদেশ সরকারেরও একটা বক্তব্য দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের ওই বক্তব্যকে ‘জ্বলন্ত মিথ্যা’ অভিহিত করে ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদ।

অবসরপ্রাপ্ত এই মেজর জেনারেল বলেন, মিয়ানমারে নাগরিকত্বের যে সমস্যা, সেটি সামরিক বাহিনী তৈরি করেছে। বর্তমান নির্যাতনের জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করে রশীদ বলেন, অবশ্যই সেনাবাহিনী এখানে-ওখানে যত নির্যাতন-নিপীড়ন এবং বিশ্ব সম্প্রদায় যা বলছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে সেনাবাহিনী। তিনি হচ্ছেন সেই সেনাবাহিনীর প্রধান, তিনি তো দায় এড়াতে পারেন না। সেজন্য তিনি এ ধরনের উল্টাপাল্টা ও ঐতিহাসিক অসত্য কথা বলছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist