নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

এখনো কমছে না চালের দাম

সংকট কাটাতে মজুদ দরকার ৮-১০ লাখ টন

কিছুতেই চালের দাম কমছে না। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বৃদ্ধি, খোলা বাজারে চাল বিক্রিসহ সরকারের নানা উদ্যোগের পরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের বাজার। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাধ্য হয়ে মাঠে নেমেছে সরকার। অবৈধ মজুদ ঠেকাতে ও সংশ্লিষ্ট চালকল মালিকদের গ্রেফতারে গতকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে অভিযান। বিশেষ করে গুদামে অতিরিক্ত চাল মজুদ রাখার অভিযোগে দুই চালকল মালিক ও নেতা আবদুর রশিদ ও লায়েক আলীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। গতকাল পর্যন্ত অবশ্য কাউকেই গ্রেফতার করা যায়নি। সংকট উত্তরণে আজ চালকল মালিক, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করবে বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

পাশাপাশি গত রোববার থেকে সারাদেশে ৬২৭টি ট্রাকে করে এমএসের চাল বিক্রি শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। গতকালও ঢাকা মহানগরীতে ১২০টি ট্রাকে তা বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বদরুল হাসান। ঢাকায় চালের সঙ্গে আটাও বিক্রি হচ্ছে। তবে চালের দাম দ্বিগুণ করে ৩০ টাকা হওয়ায় এবং বিক্রি হওয়া আতপ চালের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় চালের আশানুরুপ ক্রেতা মিলছে না বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা সময় উদ্যোগ নেয় ঠিকই; কিন্তু শেষপর্যন্ত সেগুলো বাস্তবায়ন হয় না। এর আগেও মিল মালিকদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষনা দেওয়া হয়েছিল। কালো তালিকা পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু কোন চালকল মালিকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ফলে এসব সিন্ডিকেট কৃত্রিমভাবে চাল সংকট দেখিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সরকার এর আগে এক হাজার ৩০০ মিলমালিককে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করেনি। এখন আবার তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে। তবে সেই নির্দেশনা কার্যকর করতে পারবে কি-না সন্দেহ রয়েছে। কারণ সরকারের চালের গুদামে মজুদ তলানিতে। মজুদ না থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন মিলমালিক ও ব্যবসায়ীরা। এই সুযোগই কাজে লাগাচ্ছেন তারা। তবে এ সময় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলে বাজারে চাল সংকটের আশঙ্কাও করেন এই বাজার বিশ্লেষক। তার মতে, যেহেতু সরকারের হাতে চাল নেই। তাই এ মুহূর্তে ব্যবস্থা নিলে তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চাল সরবরাহ নাও করতে পারেন। তবে এখন মিলমালিক ও ব্যবসায়ীদের কঠোর নজরদারিতে রেখে চালের সরবরাহ বাড়াতে হবে।

গত ১৫ দিনের ব্যবধানে সব ধরনের চালে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে বেড়েছে। বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারে ৫২ টাকা কেজির নিচে মোটা চাল (ইরি, গুটি স্বর্ণা) নেই বললেই চলে। আর ভালো মানের নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজিতে। এ ছাড়া বিআর-আটাশ ৫৪-৫৬ টাকায়, মিনিকেট ৬০-৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষের রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠছে।

চালের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে কালশীর মুন্না জেনারেল স্টোরের হাবিব জানান, কাস্টমাররা অভিযোগ করেন, দাম নাকি আমরা বাড়াই। কিন্তু আমাদেরও বেশি দামে কিনে আনতে হচ্ছে। যেসব মিলমালিকরা দাম বাড়াচ্ছেন, সরকার তাদের ধরলেই দাম কমে যাবে। একই বাজারে চাল কিনতে আসা কালশীর স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঈদের পর চাল কিনতে এসে দেখলাম দাম বেড়ে গেছে। ভাবলাম কদিন পর কমে যাবে। এখন দেখছি আরো বেড়েছে, আমাদের আয়-রোজগার তো আর বাড়ে না।

বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, চালের বাজারে হঠাৎ করে অস্থিরতা তৈরি হয়নি। হাওরে অকালবন্যায় ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় দুই দফা বন্যায় বোরো ও আমন রোপা ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তখনো সরকারের গুদামে চালের মজুদ তলানিতে ছিল, কিন্তু টনক নড়েনি খাদ্য অধিদফতরের। সময়মতো চাল আমদানির উদ্যোগ নিলে বাজারে এতটা অস্থিরতা তৈরি হতো না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, চাল আমদানিতে শুল্ক যখন কমানোই হলো তাহলে তা আরো আগে কমানো হলো না কেন?

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, দর বনিবনা না হওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হয় সরকার। বাধ্য হয়ে আমদানির ওপর জোর দেয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম বেড়ে যায়। ফলে বাড়তি দামে চাল আমদানি করতে গিয়ে সরকারকে ভাবতে হচ্ছে। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে চাল আনার পরিমাণ আরো বাড়ানোর জন্য গতকাল সোমবারও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আজ মঙ্গলবার আবার এ বিষয়ে বৈঠক হবে। তবে কম্বোডিয়ার সঙ্গে আড়াই লাখ টন চাল আমদানির আলোচনা সফল হয়েছে এবং চুক্তি স্বাক্ষরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বৈঠকের পর খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ৪৪২ মার্কিন ডলার দরে এক লাখ টন আতপ চাল আমদানি করবে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন পেলে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির পর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন লাগবে। এরপর এলসি খোলা হবে। তারপর চাল আসবে।

মন্ত্রণালয় সূত্র আরো জানায়, চালের সংকট কাটাতে সব মিলিয়ে ১৬ লাখ টন ধান, চাল ও গম সংগ্রহের যে ঘোষণা খাদ্যমন্ত্রী দিয়েছিলেন, তার ৭৮ শতাংশই অর্জিত হয়নি। ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও আমদানির মাধ্যমে ধান, চাল ও গম সংগ্রহ করা গেছে চার লাখ টনের কিছু বেশি। যদিও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযানের প্রাথমিক সময়সীমা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযানের ব্যর্থতার কথা নিজেও স্বীকার করেছেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তবে এ জন্য তিনি দায়ী করেন বন্যা পরিস্থিতিকে। গত ১৬ আগস্ট সচিবালয়ে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির আন্তমন্ত্রণালয় সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এবার এক কোটি ৯১ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, হাওর ও অন্যান্য এলাকার বন্যায় তা অর্জিত হচ্ছে না। সাত লাখ টন ধান ও আট লাখ টন চাল সংগ্রহের যে পরিকল্পনা করেছিলাম, সেটাও কিনতে পারিনি।

অধ্যাপক গোলাম রহমান আরো বলেন, সরকার বাজার স্থিতিশীল রাখতে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। বেশ কিছু দেশের সঙ্গে চুক্তিও করেছে। কিন্তু পর্যাপ্ত চাল এখনো দেশে এসে পৌঁছায়নি। যতক্ষণ না সরকারের মজুদ ৮-১০ লাখ টনে না পৌঁছাচ্ছে ততক্ষণ দাম স্থিতিশীল হওয়ার সুযোগ নেই। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি বলেন, চালের ব্যবসায়ী অনেক। সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সমীচীন হবে না। কিন্তু যারা নীতিনির্ধারক তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist