প্রতীক ইজাজ

  ২৪ আগস্ট, ২০১৭

নৌপথে ঝুঁকি ফিটনেসবিহীন লঞ্চ

বর্ষা ও বন্যাজনিত দুর্যোগপ্রবণ আবহাওয়াকে মাথায় রেখে এবারের ঈদযাত্রায় নৌপথে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নির্বিঘœ যাত্রী পারাপারে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) নৌপথে বিশেষ সার্ভিস রেখেছে। ফেরি চলাচলের জন্য পুরনো চারটি ঘাটের সঙ্গে দুটি নতুন ঘাট স্থাপন করা হয়েছে। গত ঈদুল ফিতরের ১৪টি বিশেষ লঞ্চের জায়গায় এবার নামছে ২১টি লঞ্চ। নজর রাখা হবে বিভিন্ন রুটের ফেরি সার্ভিসের নির্বিঘœ চলাচলে। ফিটনেসবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নৌপথে কোস্টগার্ড ও নৌপুলিশ টহল দেবে। ঈদের তিন দিন আগে থেকে নৌপথে বালুবাহী যান চলাচল বন্ধ থাকবে। নৌপথে ডাকাতি, টিকিট কালোবাজারি, বেপরোয়া লঞ্চ চালনা কিংবা নদীর মাঝপথে থামিয়ে যাত্রী তোলাসহ নানা অসংগতির দিকে নজর রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।

ঈদে নৌপথে ঘরমুখো মানুষের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য যাত্রা নিশ্চিত করতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ‘খুবই সতর্ক’ বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি বলেন, ‘বন্যা ও অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। এবার লঞ্চে কিছুতেই অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করতে দেওয়া হবে না। গতবারের তুলনায় বিশেষ লঞ্চ বেশি হওয়ায় যাত্রীদের ছাদে চাপতে হবে না।’ কিন্তু ঈদযাত্রার সময় যত ঘনিয়ে আসছে উদ্বেগ ততই বাড়ছে। কারণ গত ঈদুল ফিতরের সময়ও দেওয়া প্রতিশ্রুতির অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে মানুষকে। এবার এমনিতেই বর্ষাকাল। দেশজুড়ে বন্যা। নৌপথের প্রধান নদীগুলোর পানি গতকালও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি আরো বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষও। ফলে এবারের ঈদযাত্রায় প্রাকৃতিকভাবেই ঝুঁকি কিছুটা বেশি। তার ওপর বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে চলছে ফিটনেসবিহীন ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চ মেরামাতের কাজ। সরকারের তালিকাভুক্ত ঝুঁকিপুর্ণ লঞ্চগুলোকে এখনো অপসারণ করা যায়নি। নির্বিঘœ লঞ্চ চলাচলে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এমনকি ঈদে নৌযাত্রাকে নিরাপদ ও নির্বিঘœ করতে সরকারের সমন্বয় সভায় নেওয়া নানা পদক্ষেপের অধিকাংশই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। সেই সঙ্গে রয়েছে লঞ্চ অনুপাতে অধিক যাত্রী।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, এবারও ঈদে নৌপথে ঝুঁকি থাকছে। বিআইডব্লিউটিএর সাতটি পোর্ট থেকেই প্রতি বছর ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ দিয়ে যাত্রী পরিবহনের অভিযোগ করা হয়। সে সমস্যার সমাধান হয়নি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, আরিচা, বরিশাল ও খুলনাÑসাতটি পোর্টে কড়া নজরদারি রাখা হলে নির্বিঘœ যাত্রা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, কিছুতেই ত্রুটিপূর্ণ নৌযান নামতে দেওয়া যাবে না। অদক্ষ মাস্টার ও চালক পরিহার করতে হবে। সতর্ক নজর রাখতে হবে যেন অতিরিক্ত যাত্রী বহন না হয়। এ ছাড়া নদীপথে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট, ফায়ার বাকেট, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, বালুভর্তি বাক্স বা বালতি এবং হস্তচালিত পানির পাম্পের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নদীপথের সিগন্যাল বাতিগুলো নিশ্চিত করতে হবে।

এমন অবস্থার মধ্যেই আগামী বৃহস্পতিবার থেকে ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষের মূলস্রোত নামবে পথে। দেশের ৩৭ জেলার উপকূলীয় অঞ্চলসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৪১ নৌরুটেও চাপবে মানুষ। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নৌযাত্রীদের নিয়ে কর্মরত সংস্থাগুলো। তাদের মতে, বর্ষাকাল ও বন্যার কারণে দেশের নদনদীর অবস্থা ভালো না। পানি বাড়ছে। নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে এবার নৌপথে ঈদযাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। নৌ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় খোঁজ নিয়ে ঈদযাত্রায় নৌপথের এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এ বছর ২ সেপ্টেম্বর ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হবে। তিন দিনের সরকারি ছুটি শুরু হচ্ছে ১ সেপ্টেম্বর থেকে।

এবার ঈদে নৌপথে যাত্রী পারাপার নির্বিঘœ করতে বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএ বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা গেছে। বিআইডব্লিউটিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম মিশা জানান, ঢাকা-খুলনা নৌপথে সরকারের দুটি নতুন বিলাসবহুল জাহাজ থাকছে। পাশাপাশি যাত্রী বহন করবে চারটি প্যাডেল স্টিমার বা রকেট। এসব জাহাজ ও রকেট নিয়মিত ট্রিপের পাশাপাশি অতিরিক্ত ট্রিপ দেবে। উপকূলীয় অঞ্চল চট্টগ্রাম-হাতিয়া-সন্দ্বীপে হাজার যাত্রী ধারণক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি বড় জাহাজ সমুদ্রপথে চলবে। এ ছাড়া দ্বীপ থেকে দ্বীপে এবং মূল ভূখ- থেকে দ্বীপে চলাচলের জন্য বিশেষ লঞ্চ থাকছে। এসব জাহাজ, লঞ্চ ও রকেট রাজধানী থেকে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রী বহন করবে। এ ছাড়া রাজধানী থেকে দক্ষিণ-উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলের ২৭ জেলায় যোগাযোগের মাধ্যম ফেরি। বন্যার কারণে এবার আরিচা ও মাওয়ায় নিয়মিত চারটি ফেরিঘাটের পাশাপাশি অতিরিক্ত দুটি ফেরিঘাট স্থাপন করা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিসির এই কর্মকর্তা আরো বলেন, অনেক নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি আরো বাড়তে পারে। সেটি বিবেচনায় রেখে নৌযানের প্রস্তুতি রয়েছে। তবে যাত্রীদেরও অতিরিক্ত সাবধানতা নিয়ে চলাচল করতে হবে। এবার কিছুতেই ফিটনেসবিহীন লঞ্চ ও অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে কোনো নৌযান চলাচল করতে দেওয়া হবে না। বিশেষ করে সময়মতো নৌযান ছাড়া ও গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে সতর্ক কর্তৃপক্ষ।

একইভাবে বেসরকারি নৌযান-নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরকারের বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক বলেন, বন্যার কারণে এবার ঈদে যাত্রী বহনে বিশেষ ও সতর্ক প্রস্তুতি রয়েছে। নদনদীর পানি বাড়ছে। নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। আশা করছি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও নিরাপদেই যাত্রী বহন করা যাবে। যমুনা-পদ্মা নদীতে ভাঙন দেখা দেওয়ায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটের অবস্থা কিছুটা খারাপ। তাই সেখানে নতুন দুটি ঘাট স্থাপন করা হয়েছে। অন্য তিনটি ঘাট ভালো রয়েছে। বর্তমানে ছয়টি ঘাটই চালু রয়েছে। স্রোতের কারণে ফেরি চলাচলে কিছুটা বিঘœ ঘটতে পারে। নদনদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ১৯টি ফেরির মধ্যে বর্তমানে ১৪টি ফেরি চলছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে এবার বেশি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। ফিটনেসবিহীন কোনো লঞ্চ চলতে দেওয়া হবে না। সেগুলো কোনো ঘাটে ভিড়তে পারবে না। যাতে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে না পারে, সে জন্য নৌপথে বিশেষ টহল থাকছে।

কিন্তু সরকারের এসব প্রস্তুতিতে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না নৌপথ বিশেষজ্ঞ জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক। তিনি বলেন, অনেক লঞ্চে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট, বয়া ইত্যাদি নিশ্চিত করা হয়নি। কিছু লঞ্চে এসব সামগ্রী থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় যেমন কম, তেমনি অনেকগুলো এতই পুরনো যে মানুষকে পানিতে ভাসিয়ে রাখার মতো সক্ষমতাও সেগুলোর নেই। লঞ্চে রেলিংযুক্ত সিঁড়ি দেখা যায়নি। এমনকি লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বহন ঠেকাতে এবার নৌ-অধিদফতরের দুটি, বিআইডব্লিউটিএর একটি ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের একটিসহ চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় নৌযান না থাকায় সে সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে, সে নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যদিকে, ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ত এখন লঞ্চমালিকরা। ঢাকা নদীবন্দরসহ আশপাশ জুড়ে ২৭টি ডকে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। ফিটনেসবিহীন লঞ্চগুলোকে নতুন আদল দিতে জোড়া দেওয়া হচ্ছে লঞ্চের ভেঙে যাওয়া বিভিন্ন অংশ। মেঝে কিংবা কার্নিশে লাগানো হচ্ছে লোহার পাত। পরিবর্তন করা হচ্ছে ইন্টেরিয়ার ডিজাইনে। এমনকি বুড়িগঙ্গার পারে কেরানীগঞ্জের তেলপট্টি ও কেরোসিনপট্টি অংশের ইয়ার্ডে বেশ কয়েকটি লঞ্চের নিচের অংশও মেরামত করতে দেখা গেছে। এ ব্যাপারে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রতিবারের মতো এবারও এসব ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ ঠেকাতে পারবে না কর্তৃপক্ষ। সরকারি নৌযানের অপ্রতুলতাই বেসরকারি ঝুঁকিপূর্ণ নৌযানে যাত্রী পরিবহনের সুযোগ পাচ্ছে।’

এ ছাড়া দেশের নৌপথের ২৫টি পয়েন্টকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি। এসব স্পর্শকাতর স্থানে মনিটরিং জোরদার করারও দাবি জানিয়েছে কমিটি। পয়েন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী, চরগজারিয়া পাইলট স্টেশন, কাপ্তাই হ্রদ এলাকা, চাঁদপুরের হরিণা ফেরিঘাট, বরিশাল, পটুয়াখালী, কাউখালী পাইলট স্টেশন, খুলনা, মংলা পাইলট স্টেশন, আংটিহারা বা শেকবাড়িয়া পাইলট স্টেশন, মাওয়া-কাওড়াকান্দি, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, বাগাবাড়ি বন্দর, সদরঘাট নদীবন্দর, নারায়ণগঞ্জ, মীরকাদিম, টঙ্গী-আশুলিয়া-ডেমরা, ভৈরববাজার বা আশুগঞ্জ, চামড়াঘাট, ছাতক, লেপসিয়া, খালিয়াজুড়ি, কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার, নোয়াপাড় প্রভৃতি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist