প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৮ আগস্ট, ২০১৭

ভোক সহ্য হয় না, মোর জন্যে একনা খাবারের ব্যবস্থা করি দ্যাও’

উত্তরাঞ্চলে পানি কমছে, খাদ্যের জন্য হাহাকার * দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে বন্যার অবনতি

‘ভোক (ক্ষুধা) সহ্য হয় না, মোর জন্যে (আমার জন্য) একনা (একটু) খাবারের ব্যবস্থা করি দ্যাও। এই বয়সে যদি না খায়া মরং (না খেয়ে মরি) তাইলে কী হইবে বাবা!’ ছয় দিন ধরে কুড়িগ্রামের পাঁচগাছী ইউনিয়নের ঝাকুয়াপাড়ার যাত্রাপুরগামী পাকা রাস্তার ধারে আশ্রয় নিয়ে থাকা ৮০ বছরের বৃদ্ধা ছবিরন কোনো ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে খাদ্যের জন্য এভাবেই নিজের আকুতি প্রকাশ করেন। শুধু কুড়িগ্রামের ছবিরন নন, ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন বন্যাদুর্গত উত্তরাঞ্চলের হাজারো মানুষ। জানা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির (কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়ার) উন্নতি হতে শুরু করেছে। অপরদিকে দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চল (মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মুঞ্জিগঞ্জ, শরীয়তপুর) বন্যা পরিস্থিতি অবনতিশীল রয়েছে। এ ছাড়া মধ্যাঞ্চলে ঢাকার চতুর্দিকের পাঁচটি নদীর পানি বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার হতে ১২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। এদিকে, বন্যাদুর্গত বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

কুড়িগ্রাম : আরিফুল ইসলাম জানান, কুড়িগ্রামের পাঁচগাছী ইউনিয়নের ঝাকুয়াপাড়া, ৭নং ওয়ার্ড, যাত্রাপুরগামী রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া তহিমা (৩৫)। মানসিক বিকারগ্রস্থ স্বামী তাকে ছেড়ে গেছে অনেক আগে। দুই সন্তানের পেটে খাবার জোগাতে দিনমজুরের কাজ করতেন। সর্বনাশা বন্যা কর্মের সেই সুযোগটাও কেড়ে নিয়েছে। রাস্তার ধারে আশ্রয় নেওয়া তহিমা এখন নিজ সন্তানদের তিন বেলা খাবারও দিতে পাচ্ছেন না। ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে হতাশা আর ক্ষোভ প্রকাশ করে রাস্তার ধারে আশ্রয় নেওয়া বানেছা নামে এক বানভাসি নারী বলেন, ‘হামার কি এক মুঠও হক নাই! পাঁচ-ছয় দিন ধরি রাস্তাত পড়ি আছি, মেম্বার-চেয়ারম্যান কি হামাক দেখে না?’

অনেক বানভাসি পরিবার ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ার কথা স্বীকার করে পাঁচগাছী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলওয়ার হোসেন জানান, ‘আমাকে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয় আমি তাই বিতরণ করি। এতে অনেক পরিবার ত্রাণ বঞ্চিতই থাকে, আমি কী করতে পারি।’

কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে এ কে এম মজাহারুল ইসলাম জানান, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনন্তপুর উচ্চবিদ্যালয়, অনন্তপুর মহাবিদ্যালয় ও হাতিয়া ভবেশ আশ্রয় কেন্দ্র সরেজমিন ঘুরে বানভাসিদের দুর্ভোগের কথা জানা যায়। কলাতিপাড়া গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ বাহের আলীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদে তার শেষ সম্বল বাড়ি-ভিটাটুকুও বিলীন হয়ে গেছে। বাঁধের রাস্তার পাশে ঝুপড়িঘরে বসবাস করতেন তিনি। সেখানেও ঠাঁই হয়নি তার। অবশেষে অনন্তপুর আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নেন। পাঁচ দিন অতিবাহিত হলেও একমুঠো ত্রাণ জোটেনি তার ভাগ্যে। কম্পোপালের ঘাটের ৭০ বছরের সাবুল মিয়া, দাগারকুঠি গ্রামের ৭৮ বছরের বিষু চন্দ্র দাস,৭০ বছরের পচানী বালা, মাধব চন্দ্র দাস (৫০), কুকিল চন্দ্র দাস (৫০), সুদির চন্দ্র দাস (৩৫) ও কলাতিপাড়া গ্রামের নূরবক্ত (৫৫) একই কথা বলেন। এসব বানভাসি মানুষের দুর্ভোগের চিত্র স^চক্ষে দেখলে দুমড়ে-মুচড়ে যায় হৃদয়। উলিপুর উপজেলা ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীবেষ্টিত আটটি ইউনিয়নের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ স্মরণকালের এ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। এ নদীপাড়ের দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। পাচ্ছে না তারা শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসেবা।

জামালপুর : জামালপুরের ইসলামপুর থেকে সাহিদুর রহমান জানান, ইসলামপুরে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যাদুর্গত এলাকা ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। বন্যায় তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফসলি জমির মাঠ, পুকুর ও গ্রামের পর গ্রাম। চরম দুর্ভোগে পড়েছে বন্যাকবলিত এলাকা মানুষ। রেললাইনে পানি ওঠায় জামালপুর থেকে ইসলামপুর, সরিষাবাড়ি রুটে ট্রেন ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল এবং ২০১৬ সালে ছিল ১২১ সেন্টিমিটার। এসব রেকর্ড ভঙ্গ করে চলতি বন্যায় ১৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার যমুনার পানি কিছুটা কমে বিপৎসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। যমুনার পানি কিছুটা কমলেও জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এতে জেলার ইসলামপুরে দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

নওগাঁ : মান্দা প্রতিনিধি জানান, আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মান্দায় নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে অন্তত ৩০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ছোট যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নওগাঁ জেলার রক্ষা বাঁধ উপচে এবং বাঁধে আউটলেট নওগাঁ শহরের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এর ফলে শহরের ডিগ্রির মোড়, উকিলপাড়া, জেলা প্রসাশকের বাসভবন, কোট এলাকাসহ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। উকিলপাড়া সড়ক, মুক্তির মোড়ের সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নওগাঁ ছোট যমুনা নদীতে পানি বিপৎসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার ধামইরহাট উপজেলার ও আত্রাই নদী ১৭০ সেন্টিমিটার মান্দা আত্রাই নদী, জোতবাজার ১১ সেন্টিমিটার এবং আত্রাই উপজেলার আত্রাই নদীতে ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বর্তমান অসহায় পরিবারগুলো বিশ্ব বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। গত সোমবার পর্যন্ত কোনো সরকারি সাহায্য বা ত্রাণ তাদের কাছে না পৌঁছায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বিজ্ঞপ্তি: বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল সকাল ১১টা পর্যন্ত সর্বশেষ বন্যা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়,দেশের উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি কমতে শুরু করায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে। তিস্তা-ধরলা-দুধকুমার অববাহিকায় নদীর পানি হ্রাস অব্যাহত রয়েছে, এই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে । এছাড়া গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও তা বর্তমানে বিপদসীমার প্রায় ৬৭ থেকে ১৩৪ সেন্টিমিটারম নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মেঘনা অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতি আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় উন্নতি অব্যাহত থাকবে।

বিজ্ঞপ্তিতে বন্যার পূর্বাভাসে আরও বলা হয়,ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ভারতীয় অংশের আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টায় গড়ে ৩০ সেন্টিমিটার পানি হ্রাস পেতে পারে। বাংলাদেশ অংশের ব্রহ্মপুত্র-যমুনার বিভিন্ন্ পয়েন্টে আগামী ৭২ ঘণ্টায় হ্রাস অব্যাহত থাকবে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকবে, তবে এই নদীর পানি বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় কমে আসছে এবং বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে । মেঘনা অববাহিকার নদীর পানি আগামী ৪৮ ঘন্টায় হ্রাস অব্যাহত থাকবে।

এতে বলা হয়,গঙ্গা- ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা এই তিন অববাহিকার মধ্যে গঙ্গা পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে, ব্রহ্মপুত্রের উজানের ভারতীয় অংশে এবং মেঘনা অববাহিকার ভারতীয় ও বাংলাদেশ অংশে পানি হ্রাস অব্যাহত আছে। বিগত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর ভারতীয় অংশের গোহাটিতে (বাংলাদেশ সীমান্ত হতে ১৮০ কিলোমিটার উজানে) ৪৩ সেন্টিমিটার পান্ডুতে (বাংলাদেশ সীমান্ত হতে ১৬০ কিলোমিটার উজানে) ৩৪ সেন্টিমিটার, গোয়ালপাড়া (বাংলাদেশ সীমান্ত হতে ৯০ কিলোমিটার উজানে) ২৬ সেন্টিমিটার এবং ধুবরী (বাংলাদেশ সীমান্ত হতে ২৫ কিরৈামিটার উজানে) ১৪ সেন্টিমিটার পানি সমতলে হ্রাস পেয়েছে ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist