নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৬ আগস্ট, ২০১৭

৩২ নম্বরে হামলার ছক ছিল জঙ্গিদের

১১ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর ‘অপারেশন আগস্ট বাইট’ * বিস্ফোরণে নিহত ‘জঙ্গি’ সাইফুল * বিপর্যস্ত পান্থপথ

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানকে টার্গেট করেছিল জঙ্গিরা। কারণ সেখানে আত্মঘাতী হামলা চালালে শত শত লোক মেরে ফেলা সম্ভব ছিল। আর এ জন্যই শোক দিবসের আগের দিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে মাত্র ৩০০ মিটারের দূরত্বে থাকা একটি হোটেলে অবস্থান নেয় সাইফুল ইসলাম নামের এক জঙ্গি। কিন্তু গোয়েন্দাদের তৎপরতায় হামলার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর পান্থপথের একটি আবাসিক হোটেলে পুলিশের অভিযানের সময় সাইফুল ইসলাম নামের এক জঙ্গি নিহত হয়েছে। বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক জানান, গুলশান হামলার পর কোণঠাসা হয়ে পড়া নব্য জেএমবি শোক দিবসে হামলার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতার জানান দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি টিম নব্য জেএমবির এই পরিকল্পনার আগেই জানতে পেরে যায়।

এর আগে গত রোববার এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার ঘোষণা দিয়েছিলেন, জাতীয় শোক দিবসে নি-িদ্র নিরাপত্তা দিতে ধানমন্ডির হোটেল-দোকানের পাশাপাশি প্রয়োজনে বাসাবাড়িতে তল্লাশি করা হবে। অথচ শোক দিবসেই দেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের মাত্র ৩০০ মিটার দূরের একটি আবাসিক হোটেলেই অবস্থান নিয়েছিল ভয়ংকর আত্মঘাতী এক জঙ্গি।

গতকাল অভিযান শেষে আইজিপি শহীদুল হক আরো জানান, নিহত ওই যুবক নব্য জেএমবির সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য। আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে সে সুইসাইড ভেস্টে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। নিহত জঙ্গি শিবিরকর্মী ছিল এবং তার বাবা আবুল খায়ের মোল্যাও খুলনার জামায়াত নেতা। তিনি আরো জানান, অভিযানের সময় তাকে সারেন্ডার করতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি। উল্টো পুলিশের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করেছিল ওই জঙ্গি। তাকে গ্রেফতার করতে গেলে দুটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। একপর্যায়ে আত্মঘাতী বিস্ফোরণের আগেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ওই জঙ্গি। নিহত সাইফুল নিখোঁজের তালিকায় ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পুলিশ জানায়, এক জঙ্গির অবস্থানের তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালের কাছে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের ভবনটি ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। জঙ্গি সাইফুল হোটেলের চারতলার ৩০১ নম্বর কক্ষে অবস্থান করছিল। ওই এলাকার প্রতিটি গলি এবং বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেয় সোয়াত ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন অগাস্ট বাইট’। পুলিশ প্রায় চার ঘণ্টা ধরে হোটেলটি ঘিরে রাখার পর সকাল পৌনে ১০টার দিকে চারতলার পূর্বপাশের রুমে গুলি ও বিকট বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। বিস্ফোরণে হোটেলের চারতলার রাস্তার দিকের অংশের দেয়াল ও গ্রিল ধসে নিচে পড়ে। ধ্বংসস্তূপের নিচে একজনের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে পুলিশ নিশ্চিত করে ওই যুবকের নাম জঙ্গি সাইফুল ইসলাম।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, গত সোমবার নিহত জঙ্গি সাইফুল হোটেলের কক্ষ ভাড়া নেয়। হোটেলের রেজিস্ট্রার খাতার তথ্য অনুযায়ী, ওই যুবকের নাম সাইফুল ইসলাম। তার বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ায়। সে খুলনার বিএল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অর্নাস শেষ বর্ষের ছাত্র। গত ৪ আগস্ট চাকরি খোঁজার কথা বলে সে ঢাকায় আসে। এরপর বিভিন্নস্থানে থাকার পর সবশেষে নাশকতা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ওই হোটেলে অবস্থান নেয়।

মনিরুল আরো বলেন, জাতীয় শোক দিবসকে কেন্দ্র করে প্রচুর মানুষের ভিড় হয়। নব্য জেএমবির একটা সেল বড় নাশকতার পরিকল্পনা করেছে। সেটা আগে থেকে আমাদের জানা ছিল। নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে একটা হামলার জন্য। তিনি বলেন, সোমবার আমরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হই ৩২ নম্বরকে টার্গেট করে এক বা একাধিক জঙ্গি পান্থপথ এবং এর আশপাশে অবস্থান করছে। এরপর ওই এলাকা একাধিকবার ব্লকরেইড দিয়ে তল্লাশি করা হয়। রেইড চলাকালে লেক সার্কাস পশ্চিম পান্থপথের ৫৭/১/সি এর হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের অন্যান্য কক্ষে নক করার সঙ্গে সঙ্গে খুলে দেয়। কিন্তু একটি কক্ষ নক করার পর খোলেনি। হোটেলের কর্নারের ৩০১ নম্বর কক্ষে নক করার পর ভেতর থেকে জানায়, সকালের আগে খুলব না। করিডোরের পাশে জানালা দিয়ে ব্যাগ ও পা দেখতে পান পুলিশ সদস্যরা। তখন পুলিশ সদস্যরা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়। পরে পুলিশ অভিযান চালায়। এর আগে পান্থপথের ওই রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে আটকে পুরো এলাকায় ঘিরে রাখে পুলিশ ও পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াটের সদস্যরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল পৌনে ১০টার দিকে বিকট বিস্ফোরণের সঙ্গে হোটেল ভবনের চারতলার দেয়াল ও গ্রিল ভেঙে নিচে পড়লে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। স্কয়ার হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা হাসপাতালের ভেতরে দিকে চলে যান। এর পরপরই সামনের রাস্তা দিয়ে আহত অবস্থায় একজনকে নিয়ে যেতে দেখা যায়। তেজগাঁও থানার ওসি মাজহার হোসেন জানান, আহত এক ব্যক্তি ব্যাংকের বুথে টাকা তুলতে যাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণের ফলে ইটের টুকরো ছিটকে গিয়ে তার মাথায় লাগে। বিস্ফোরণের কয়েক মিনিট পরই হোটেলের চতুর্থ তলার ওই অংশে দেখা যায়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে হোটেল ভবনের চতুর্থ তলায় প্রবেশ করেন পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা। সেখানে আরো বিস্ফোরক আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখেন তারা।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন জানান, আত্মঘাতী সাইফুলের সঙ্গে তিনটি বোমা ছিল। অভিযানের সময় ওই জঙ্গি দুটি বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রথমটা দরজা ভাঙার সময় বিস্ফোরিত হয়, দ্বিতীয়টি সে নিজে ফাটায়। পরে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের সদস্যরা ভেতরে একটি ট্রাভেল ব্যাগে বোমার সন্ধান পায়। ব্যাগ থেকে বের না করে ওই অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রিতভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। ভেতরে তল্লাশি করে আর কোনো বিস্ফোরক পাওয়া যায়নি। পুলিশের অভিযান শেষ হলে ভেতরে ঢুকে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা আলামত সংগ্রহ করে। এরপর বিকেলে নিহত জঙ্গির লাশ ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।

যেভাবে জঙ্গি সাইফুলকে শনাক্ত করল পুলিশ : পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল, জাতীয় শোক দিবস ঘিরে নাশকতার পরিকল্পনা করছে নব্য জেএমবি। এ জন্য আগে থেকেই তৎপর ছিল গোয়েন্দারা। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই গত রোববার ডিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, জাতীয় শোক দিবসে নি-িদ্র নিরাপত্তা দিতে ধানম-ির হোটেল-দোকানের পাশাপাশি প্রয়োজনে বাসাবাড়িতে তল্লাশি করা হবে।

এদিকে, গত সোমবার গোয়েন্দারা জানতে পারেন, পান্থপথের কোনো একটি হোটেলে অবস্থান নেবে জঙ্গিরা। এ জন্য ধানম-ি ও কলাবাগান থানা পুলিশকে সতর্কও করা হয়। এরই অংশ হিসেবে পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে দুর্ধর্ষ জঙ্গি সাইফুলকে শনাক্ত করে নিউমার্কেট থানা পুলিশ। নিউমার্কেট থানার ওসি আতিকুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম ৩২ নম্বর রোডের কাছে শুক্রাবাদ ও পান্থপথ এলাকায় সোমবার রাত পৌনে ৩টার দিকে ব্লক রেইড দেয়। তারা হোটেল ওলিওর নিচতলায় এসে জানতে পারে, হোটেলে ১৩ জন বোর্ডার রয়েছে। ম্যানেজার জসিমের অনুমতি নিয়ে পুলিশ প্রতিটি কক্ষ তল্লাশি চালায়।

একপর্যায়ে চারতলায় ৩০১ নম্বর কক্ষে দরজায় কড়া নাড়লে ভেতর থেকে বলা হয়, ‘এখন অনেক রাত, কাল সকালে কথা হবে’। ওসি তখন দরজার পাশের জানালাটি খোলার অনুরোধ করেন। ওই যুবক ভেতর থেকে জানালাটি খুললে ওসি বাইরের বিদ্যুতের সুইচ অন করে দেন। এ সময় কক্ষের ভেতরে দেখা যায়, একজন যুবক কালো রঙের ট্রলি ব্যাগ হাতে নিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে আসছে। ওসি তখন বাইরে থেকে দরজা লক করে দেন। মুহূর্তের মধ্যে তিনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান।

পরে হোটেলের রেজিস্ট্রার ঘেঁটে ওসি জানতে পারেন, গত সোমবার খুলনা থেকে এসে খাইরুল নামে হোটেলে ওঠে ওই যুবক। কিন্তু এই যুবক হোটেল রেজিস্ট্রারে সাইফুল ইসলাম নামে স্বাক্ষর করে। এরপর পুলিশের সন্দেহ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। মুহূর্তেই ঘটনাস্থলে আসে সোয়াত ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সুসজ্জিত বাহিনী। একপর্যায়ে ওই জঙ্গি পরপর দুটি বিস্ফোরণ ঘটায়। তৃতীয় বিস্ফোরণের আগেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয় জঙ্গি সাইফুল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist