নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৬ আগস্ট, ২০১৭

শোকে শ্রদ্ধায় বঙ্গবন্ধু স্মরণ

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সপরিবারে নিহতদের গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে জাতি। স্মৃতিভারাতুর মানুষ বিনম্রচিত্তে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন স্বাধীনতার মহানায়ক, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সে কালরাতে শহীদ স্বজনদের স্মরণ করে ফেলেছে চোখের জল। দিবসটিকে ঘিরে একদিকে যেমন ছিল রাষ্ট্রীয় যথাযোগ্য মর্যাদা ও নানা আনুষ্ঠানিকতা; তেমনি ব্যক্তি থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে দিবসটি পালনে ছিল নানা আয়োজন।

গতকাল ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদাতবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। এর মধ্য দিয়ে বাঙালির ইতিহাসে এক কালিমালিপ্ত অধ্যায় সংযোজিত হয়েছিল।

প্রাণের অর্ঘ্যে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি একাত্তরের পরাজিত শক্তির দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ ও নির্মূল করে আরো উন্নত দেশ গড়ার শপথ নিয়েছে জাতি। দাবি জানিয়েছে বিদেশে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকরের।

মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে এতটুকু ভোলেনি কৃতজ্ঞ বাঙালি। সেই কালরাতকে স্মরণে শোকস্তব্ধ ছিল দেশ, দেশের মানুষ। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর নশ্বর শরীর কেড়ে নিলেও তার অবিনশ্বর চেতনা ও আদর্শ যে মৃত্যুঞ্জয়ী, ঘাতকের সাধ্য ছিল না ইতিহাসের সেই মহানায়কের অস্তিত্বকে বিনাশ করে- কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি সর্বজনীন শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে প্রতিবছর তারই জানান দেয়। শেখ মুজিব বাড়ন্ত বটবৃক্ষের মতো ধাপে ধাপে বাঙালির সামনে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন। প্রয়াণের এত বছর পরও তিনি সমানভাবেই রয়েছেন সমুজ্জ্বল।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর : সকালে ঢাকার ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে তার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি। সকাল ৬টার মধ্যেই সর্বস্তরের মানুষের পদচারণায় ভরে ওঠে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়ক। প্রথমেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে পৃথক পৃথকভাবে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর এ মহান নেতার প্রতি সম্মান জানিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল বাঙালি জাতির স্থপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এ সময় বিউগলের করুণ সুর বাজানো হয়। পরে ১৫ আগস্ট শহীদ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, ১৪ দল ও শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডির ৩২ এর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাসভবনে যান (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর) এবং তারা সেখানে কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী বনানী কবরস্থানে যান। সেখানে শায়িত ১৫ আগস্টের শহীদ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ সে রাতে শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে ফাতেহা পাঠ ও বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। বাদ জোহর বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এই মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেন। এ সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নিহত সদস্যদের আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়। মিলাদ মাহফিলে রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্যগণ, সংশ্লিষ্ট সচিবগণ, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ ও বঙ্গভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন। এর আগে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র দরবার হলে প্রদর্শন করে।

সেদিন ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, একে একে খুন করেছে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আরিফ, বেবি ও সুকান্ত, আবদুল নাঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকেও হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা কর্নেল জামিলকেও সেদিন ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। তবে সেই সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। সরকারিভাবে পালিত হয়েছে দিবসটি। ছিল সরকারি ছুটির দিন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ভবনসহ বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সারা দেশে মসজিদগুলোতে বাদ জোহর বিশেষ মোনাজাত এবং মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিশু একাডেমি এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক বক্তৃতার আয়োজন করে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতারা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন।

ঢল নামে মানুষের: এর পরপরই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এ সময় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের ঢল নামে সেখানে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষ আসে বঙ্গবন্ধু ও সে রাতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। এ সময় সব পথ এসে মিশে ধানমন্ডিতে। দিনভর বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানান। হাতে কালো ব্যানার ও বুকে কালোব্যাজ পরিধান করে আসেন নারী-পুরুষ, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষ। ৩২ নম্বর বাড়িকে ঘিরে শোকে স্তব্ধ হয়ে ওঠে চারপাশ। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানতে গিয়ে চোখের জলে সিক্ত হয় বেদি। মানুষ কাঁদে। শোকে শ্রদ্ধায় উচ্চারণ করেন বঙ্গবন্ধুকে। স্মরণ করেন সে রাতে শহীদদের। ঘৃণাভরে উচ্চারণ করেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নাম।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ছিল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও নানা শ্রেণি-পেশাসহ সর্বস্তরের শোকার্ত মানুষের ঢল। রাজধানী জুড়ে দেয়ালে দেয়ালে ছিল শোকের পোস্টার, শোক তোরণ, কালো পতাকা। দিনমান বাজে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের সেই ৭ মার্চের ভাষণ ও দেশাত্মবোধক গান। শহরের মোড়ে মোড়ে ও অলিগলিতে মিলাদ মাহফিল ও কাঙালি ভোজের আয়োজন ছিল। এসব কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া মানুষ ছিল শোকাচ্ছন্ন।

টুঙ্গিপাড়ায় সমাধিতে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা: সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এই মহান নেতার প্রতি সম্মান জানাতে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে আরেকটি পুষ্পাঞ্জলিও অর্পণ করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানাও উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি চৌকস দল জাতির পিতাকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়, এ সময় বিউগলে করুণ সুর বাজানো হয়। তিনবাহিনী প্রধানগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণে এবং দেশ ও জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়। এ সময় স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, দলীয় নেতাসহ বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা জাতির পিতার সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

বিভিন্ন সংগঠনের শ্রদ্ধা: শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে যুবলীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, ছাত্রলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুবমহিলা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিক লীগ ও তাঁতী লীগের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন ঢাকা মহানগর কমিটি রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। এতে কমিটির সভাপতি বেলাল শাহ, সহ-সভাপতি শেখ জামাল আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইরফান আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক, অর্থ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন অর রশীদ, আইন ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক হুমায়ূন কবিরসহ অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist