প্রতীক ইজাজ

  ১৪ আগস্ট, ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে বিতর্ক

কঠোর অবস্থানে সরকার

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে কৌশলী ও কঠোর অবস্থানে সরকার। সরব সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ মন্ত্রী-নেতারা। কেবল রাজনৈতিকভাবেই নয়; রায়ের অসংগতি ও বিতর্কগুলো তুলে ধরে জনমত তৈরির মধ্য দিয়েও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চাইছেন ক্ষমতাসীনরা। সেইসঙ্গে সাংবিধানিকভাবে আইনি পথে লড়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তারা। বিশেষ করে এই পূর্ণাঙ্গ রায়কে কেন্দ্র করে যেন কিছুতেই বিএনপি রাজনীতি করতে না পারে এবং নির্বাচনী রাজনীতিতে এই রায়ের কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে—সেদিকেই বেশি মনোযোগ আওয়ামী লীগের। এমনকি রায়কে কেন্দ্র করে রাজনীতির ভেতর-বাইরে কোনোপক্ষই যেন কোনো ধরনের ষড়যন্তের নকশা করতে না পারে, সতর্ক নজর রয়েছে সেদিকেও।

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা রায়ের অসংগতিগুলো তুলে ধরে জনমত গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। কেবল দলীয়ভাবে নয়, সাধারণ মানুষও যাতে এই রায়ের অসামঞ্জস্য ও ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝতে পারে, সে জন্য সহজভাবে রায়ের বিভিন্ন অসংগতি ও ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এমনও বলেছেন, এই রায় একটা ষড়যন্ত্রের অংশ। সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ ধরনের ষড়যন্ত্র আরো হবে। তিনি সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তারপর থেকেই মন্ত্রী ও শীর্ষ নেতারা রায়ের বিপক্ষে জনমত গড়তে মাঠে নামেন।

সেই সঙ্গে এই রায়ের মধ্যে যেসব অসাংবিধানিক ও আইনগতভাবে সিদ্ধ নয়, এমন বিষয় রয়েছে, সেগুলোর যথার্থ আইনি ব্যাখ্যা ও কারণ তুলে ধরতে সরকার সমর্থিত আইনজ্ঞদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন দলের এক শীর্ষ নেতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য বলেন, যৌক্তিকভাবে আইনি ব্যাখ্যাসহ রায়ের অসংগতিগুলো সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরা হবে। যাতে মানুষ বুঝতে পারে কোন প্রেক্ষাপটে ও বিবেচনায় প্রধান বিচারপতি মূল রায়কে উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। এই নেতা আরো বলেন, এর মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না-তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

পাশাপাশি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক সমাধানের সিদ্ধান্তও নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো বলছে, বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী ও আইন বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ে চলে আসা ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ইতোমধ্যেই প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেছেন দলের শীর্ষ নেতারা। গত ৬ আগস্ট রোববার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেন সরকারপন্থি সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ তিন আইনজীবী। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওই সাক্ষাতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ করে আপিল বিভাগের রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে সরকার ও আওয়ামী লীগের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানায়। ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতিকে জানিয়েছেন, এ রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহলে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, যা অনভিপ্রেত। প্রধান বিচারপতিকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সরকার চায় না রায়কে কেন্দ্র করে অনাকাক্সিক্ষত কোনো পরিস্থিতি তৈরি হোক বা বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগ মুখোমুখি অবস্থানে যাক। তাই রায়ে থাকা অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ বাদ দিয়ে রাজনৈতিক মহলে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে বিচার বিভাগের দায়িত্ব আছে। প্রধান বিচারপতিকে এ দায়িত্ব নিয়ে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি নিরসন করতে অনুরোধ জানান ওবায়দুল কাদের।

তাহলে এমন পরিস্থিতির সমাধান কোন পথে—জানতে চাইলে সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সমাধানের তিনটি সহজ পথ রয়েছে। এক. আদালত ইচ্ছে করলে স্ব-উদ্যোগে পর্যবেক্ষণের অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যগুলো বাতিল করতে পারে। দুই. সরকার চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে এক্সপাঞ্জের জন্য আবেদন করতে পারে। অথবা সরকার চাইলে রিভিউ করতে পারে। এর বাইরে সমাধানের আর কোনো পথ আছে বলে আমার জানা নেই। তবে দুই পক্ষেরই উচিত আলোচনার মাধ্যমে এই পরিস্থিতির সমাধান করা। সংবিধানের প্রতি সবারই শ্রদ্ধা আছে। এখন প্রয়োজন সদিচ্ছা ও উদ্যোগ।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা আরো চলবে। আমরা মনে করি, আলোচনার মধ্য দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি নিরসন হবে। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ হলে পরে রায় নিয়ে আমরা আমাদের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করব। আপিলের প্রস্তুতিও নেওয়া হতে পারে।

আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো জানায়, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া রায় নিয়ে সরকার বা আওয়ামী লীগের কোনো আপত্তি ছিল না। সে রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আইনিপথেই যাওয়ার ইচ্ছে ছিল সরকারের। এখনো সে ইচ্ছে রয়েছে। কিন্তু রায়ে দেওয়া প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ায় পথে নামতে বাধ্য হয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। কেননা ওই পর্যবেক্ষণে ‘রাজনীতিতে ব্যক্তিবাদ’, সামরিক শাসন, ‘অপরিপক্ব সংসদ’, দুর্নীতি, সুশাসন, মুক্তিযুদ্ধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ এমন কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, যাতে বিস্মিত হয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া এ রায় ও পর্যবেক্ষণে সংবিধানবিরোধী কিছু আছে কি না-তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এতে সংবিধানপরিপন্থী কিছু থাকলে আইনি পদক্ষেপসহ সংবিধান অবমাননা মামলার দিকেও যেতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই দলের আইনজীবী নেতাদের রায় ও পর্যবেক্ষণ আরো গভীরভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমনকি ওই পর্যবেক্ষণকে নির্বাচনী রাজনীতিতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র হিসেবেও দেখছেন ক্ষমতাসীনরা।

এর ফলে এ রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে কঠোর অবস্থানে গেছে সরকার ও আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়িয়ে এ নিয়ে সৃষ্ট উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর বাইরে সারা দেশে জেলা আইনজীবী সমিতিগুলোয়ও। একদিকে রায়ে সংক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন মন্ত্রী-নেতা আদালতের পর্যবেক্ষণের কিছু বিষয়ের ও প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সমালোচনা করছেন, অন্যদিকে রায় ও পর্যবেক্ষণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সমালোচকদের পাল্টা সমালোচনা করছে বিএনপিসহ সমমনারা।

রায়ের পর্যবেক্ষণে ইতিহাস বিকৃতি দেখছেন আইনমন্ত্রী। গতকাল রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে বিচারকের অসদাচরণ হয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে বলে আইনমন্ত্রী মনে করছেন। এর আগে ষোড়শ সংশোধনীর রায় সম্পর্কে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, বাংলাদেশ এখন আর জনগণের প্রজাতন্ত্র নয়, বরং এটা বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তিনি মনে করেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে দেওয়া ওই রায় ছিল পূর্ব ধারণাপ্রসূত ও আগে থেকে চিন্তাভাবনার ফসল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই রায় ঘোষণার পর কিছুদিন চুপ থাকলেও কয়েক দিন ধরে আওয়ামী লীগের নেতারা মুখ খোলা শুরু করেছেন। তারা বিশেষ করে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন। দলের শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু করে মধ্যমসারির নেতারাও আদালতের রায় নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন। ষোড়শ সংশোধনীর রায় প্রসঙ্গে বুধবার দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করা হয়। বৃহস্পতিবার সরকারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রীও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। ১ আগস্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি রায়কে ঐতিহাসিক আখ্যায়িত করে। একই সঙ্গে রায়টিকে ইস্যু করে তারা সরকারের পদত্যাগের দাবি তুলছে। পক্ষান্তরে রায় ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একেবারেই চুপ হয়ে যায়। দলটির পক্ষ থেকে বিষয়টিকে পর্যবেক্ষণ করার কথা জানানো হয়। তবে, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের এক সপ্তাহের মাথায় গত সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করা হয়। রায়ের কয়েকটি পর্যবেক্ষণ নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সমালোচনা করেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সরকারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি দলের নেতাদের এই নিয়ে কথা বলার নির্দেশ দেন।

সেজন্য রায় ঘোষণার পর কিছুদিন চুপ থাকলেও কয়েক দিন ধরে দলটির নেতারা মুখ খোলা শুরু করেছেন। বিশেষ করে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন তারা। দল ও সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু করে মধ্যমসারির নেতা-মন্ত্রীরাও আদালতের রায় নিয়ে কথা বলছেন। কেউ কেউ অবিলম্বে প্রধান বিচারপতির স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না হলে অপসারণও দাবি করেছেন। প্রয়োজনে দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামারও হুমিক দিচ্ছেন তারা। আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের বক্তব্যে রায় ও পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা করছেন। তারা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার কঠোর সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি বঙ্গবন্ধুর প্রতি কটাক্ষ করার ‘ধৃষ্টতা’ দেখিয়েছেন। তাদের মতে, এ রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ব্যাপকভাবে অসাংবিধানিক ও অনৈতিক কথাবার্তার অবতারণা করেছেন। তারা প্রধান বিচারপতির অপসারণ দাবি করেছেন। নতুবা আগামী মাস থেকে তার অপসারণ দাবিতে টানা আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হবে বলেও জানান। তাদের অভিযোগ, রায়ের পর্যবেক্ষণে জাতীয় সংসদকে খাটো করে উপস্থাপন করা হয়েছে। সংসদে পাস না হলে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের এ রায়ের কোনো মূল্য নেই।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ষোড়শ সংশোধনী,রাজনীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist